উসামা ইবনে যায়েদ (রা) এর জীবনী পর্ব ১



রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তোমার পিতার চেয়ে "উসামার পিতা অধিক প্রিয় ছিলেন। আর উসামাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তোমার চেয়ে অধিক প্রিয়।" -আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)-এর প্রতি উমর ফারুক (রা)-এর উক্তি হিজরতের সাত বছর পূর্বের কথা। মক্কায় মুসলমানদের জন্য ছিল চরম দুর্দিন। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ প্রতিদিনই কুরাইশদের নির্মম অত্যাচারের শিকার হতেন। ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ এবং ইসলাম প্রচারের কারণে মুসলমানদের ওপর অব্যাহতভাবে অত্যাচার চলত। এহেন যুলুম-অত্যাচার আর দুর্ভাবনা ও দুশ্চিন্তার মাঝেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখে দেখা গেল আনন্দের আভাস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখে আনন্দের পবিত্র আভাস দেখে সকলেই আনন্দিত হলেন।

সংবাদ এল, উম্মুল আইমানের ঘরে আল্লাহ একটি ছেলে দান করেছেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এ সংবাদে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বড়ই খুশি হলেন। তাঁর মুখমণ্ডলে হাসি ফুটল। কে এই শিশু, যার জন্মগ্রহণের সংবাদ শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত আনন্দিত হয়েছিলেন? হ্যাঁ, এ শিশুই উসামা ইবনে যায়েদ। এ শিশুর জন্মগ্রহণের সংবাদে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতিশয় আনন্দিত হলেন। এ শিশুর পিতামাতার সন্তান লাভে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুশি হওয়ারই কথা। কারণ, তাঁরা অতি আপনজন। তাদের একজন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের "প্রিয়পাত্র যায়েদ ইবনে হারেসা এবং অপরজন উজ্জ্বল আইমান। এই শিশুর মায়ের নাম ছিল 'বারাকাতুল হাবাণীয়াশী" যাকে উম্মুল আইমান নামে ডাকা হতো। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আম্মা আমেনা বিনতে ওয়াহাব-এর ক্রীতদাসী।

আমেনার জীবদ্দশায় তিনিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লালন-পালন করেন, এমনকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মায়ের ইনতিকালের পরও একটি সময় পর্যন্ত তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সেবাযত্ন করেন। মহানবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুনিয়াতে বিচার-বিশ্লেষণের ও পার্থক্য শক্তির দু'চোখ খুলেই নিজের মা ছাড়া আর যাকে আপন বলে দেখেন, তিনি এই মহিলা। সুতরাং স্বাভাবিক কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন। প্রায়ই তাঁর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন : আমার মায়ের পর তিনিই আমার মা এবং আমার পরিবারের অবশিষ্ট মুরব্বী, যাকে নিজ বাড়িতেই রেখেছি।' তিনিই সেই সৌভাগ্যবান শিশুর মা উম্মুল আইমান আর তার পিতা ছিলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয়পাত্র যায়েদ ইবনে হারেসা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু। ইসলামপূর্ব যুগে যিনি ছিলেন তাঁর পালক-পুত্র, সম্মানিত সাহাবা, গোপনীয় বিষয়ের বিশ্বস্ত আমানতদার, নবী-পরিবারের সদস্য এবং সবার চেয়ে অধিক ভালোবাসার পাত্র। উসামা ইবনে যায়েদ-এর জন্মগ্রহণে মুসলমানগণ খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন। এ কারণে যে, যেসব ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর খুশি। প্রকাশ করেছেন, সেসব ক্ষেত্রে সাহাবীগণও খুশির বহিঃপ্রকাশ করেছেন। এ ছেলেকেই সাহাবীদের পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের "প্রিয়পাত্রের প্রিয় সন্তান' উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ছোট শিশু উসামাকে সাহাবীগণ এ উপাধিতে ভূষিত করে মোটেই বাড়াবাড়ি করেননি। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসামাকে খুবই ভালোবাসতেন। এ দুই বন্ধুর মধ্যে বয়সের পার্থক্য তো আসমান-জমিন ফারাক।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা ফাতিমাতুয়ারা ছেলে হাসান ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর সমবয়সী। হাসান দেখতে খুবই সুন্দর, গোলাপী ফর্সা এবং হুবহু তাঁর নানা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতো। আর উসামা ছিলেন খুবই কালো, খর্বাকার নাসিকা, তার হাবশী মা উম্মুল আইমানের মতো। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয়ের মধ্যে স্নেহ-ভালোবাসার কোনো পার্থক্য করতেন না। উসামাকে তাঁর এক ঊরুর ওপর বসাতেন এবং অন্য উরুর ওপর হাान। অতঃপর উভয়কেই বুকে জড়িয়ে ধরে বলতেন : اللهم إلى أنهما فأجيبهما . "হে আল্লাহ, আমি এ দু'জনকেই সমান ভালোবাসি, তুমিও তাদেরকে ভালোবাস। উসামার প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা কতটুকু গভীর ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় একটি ঘটনায়। একদিন উসামা হোঁচট খেয়ে দরজার চৌকাঠের ওপর পড়ে যাওয়ায় তার কপাল কেটে যায় এবং ক্ষতস্থান থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহাকে উসামার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত মুছে ফেলার ইঙ্গিত করেন; কিন্তু তাতে তাঁর বিলম্ব হতে দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই উঠে গিয়ে উসামার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত চুষে শুধু করে ফেলতে থাকেন এবং তাকে আদর সোহাগতরা কথাবার্তা শোনান। ও সান্ত্বনা দেন, যাতে সে সন্তুষ্ট হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসামাকে শৈশবে যেমন ভালোবাসতেন, যৌবনেও ঠিক তেমনি ভালোবাসতেন। কুরাইশদের এক অভিজাত নেতা হাকিম ইবনে হাযাম ইয়ামেনের এক বাদশাহ ইয়াযদানের নিলামকৃত মহামূল্যবান গাউন পঞ্চাশ দিনার বা স্বর্ণ মুদ্রায় খরিদ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উপহার দেন। কিন্তু ইবনে হাযাম তখনো মুশরিক থাকায় তিনি তার উপহার গ্রহণ না করে তা কিনে নেন এবং একবার মাত্র জুমআর দিনে পরিধান করে তা উসামাকে উপহার দেন। উক্ত গাউন পরে উসামা তার সমবয়সী আনসার ও মুহাজির যুবকদের মধ্যে সকাল-বিকাল ঘোরাফিরা করতেন।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.