উসামা ইবনে যায়েদ (রা) এর জীবনী পর্ব 2


উসামা যৌবনে পদার্পণ করলে তার মধ্যে চারিত্রিক ও মানবিক গুণাবলির অপূর্ব প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ জন্য তার প্রতি আরো বেশি আকৃষ্ট হন। উসামা শুধু সাধারণ অর্থেই বুদ্ধিমান ছিলেন না; বরং অসাধারণ প্রজ্ঞারও অধিকারী ছিলেন। তিনি শুধু সাহসী যোদ্ধাই ছিলেন না; বরং যুদ্ধের কলাকৌশলে তিনি ছিলেন একজন কুশলী যোদ্ধা। যে কোনো জটিল সমস্যার সমাধানে তিনি ছিলেন বিশেষ প্রজ্ঞাবান। তিনি যেমন মানবিক গুণে ছিলেন গুণান্বিত, তেমনি ছিলেন একজন মুত্তাকী ও খোদাভীরু আবেদ। উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রাহণের জন্য উসামা ইবনে যায়েন একদিন সাহাবী সন্তানদের একদল কিশোর সাহাবীসহ রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে উপস্থিত হন। রাসুলুল্লাহ সারাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যোগ্যতার ভিত্তিতে যাদের গ্রহণ করার কথা তাদের গ্রহণ করেন এবং অল্প বয়সের জন্য যাদের ফেরৎ দেওয়ার, তাদের ফেরৎ পাঠান যাদেরকে ফেরৎ 1 পাঠানো হয় তাদের মধ্যে উসামা ইবনে যায়ে অন্যতম।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জিহাদের পতাকাতলে জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহে অংশ না নিতে পারায় উসামা দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। খন্দকের যুদ্ধের প্রাক্কালেও উসামা যুবক সাহাবীদের একদল নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে হাযির হন। এবার তিনি পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে ভর করে নিজের উচ্চতা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন, যাতে করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে লম্বা মনে করে যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবার তাকে ছোট সাহাবীদের থেকে আলাদা করে নেন ও যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমিত দেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর।  

হুনাইনের যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুসলিম বাহিনী চরমভাবে পরাজয়ের মুখোমুখি হন। উসামা ইবনে যায়েদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসারামের চাচা আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ও চাচাত ভাই আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস রাদিয়াল্লাহ তাআলা আনহু এবং অন্য ছয়জন সম্মানিত সাহাবীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে ইস্পাতের প্রাচীরের মতো অবস্থান নেন। জানবার সাহাবী যোদ্ধাদের এই ক্ষুদ্রতম ইউনিটের সাহায্যেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরাজয়কে বিজয়ে রূপান্তরিত করেন এবং যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া সাহাবীদেরকে আক্রমণকারী মুশরিকদের হাত থেকে রক্ষা করেন। 

যুবক সাহাবী উসামা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু মাত্র আঠারো বছর বয়সে তার পিতা সেনাপতি যায়েদ বিন হারেসা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর পতাকাতলে মুতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি এ যুদ্ধে স্বচক্ষে তাঁর পিতার শাহাদাতের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। পিতার শাহাদাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতাও প্রকাশ না করে কেঁদে অস্থিরও না হয়ে বরং জাফর ইবনে আবী তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে বীরবিক্রমে শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। তার চোখের সামনে জাফর ইবনে আবী তালিব রাদিয়াল্লাহ আনহু শহীদ হলে সেনাপতির নেতৃত্ব আসে আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাতে। তাঁর শাহাদাতের পর খালিদ ইবনে ওয়ালীন রাদিয়াল্লাহু আনহুর নেতৃত্বে যতক্ষণ পর্যন্ত এই ক্ষুদ বাহিনীকে বিশাল রোমান বাহিনী থেকে পশ্চাদপসরণ না করানো হ ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। যুদ্ধ শেষে আল্লাহর কাছে পিতা যায়েদ ইবনে হারেসার সর্বোচ্চ পুরস্কারের আশা নিয়ে সিরিয়ার পূর্ব প্রান্তরে মৃতার যুদ্ধক্ষেত্রে পিতার লাশকে দাফন করে, তার শাহাদাতপ্রাপ্ত পিতা সেনাপতি যায়েন ইবনে হারেসার ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। এগারো হিজরীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সর্বস্তরের মুজাহিদদের নির্দেশ দেন। আবূ বকর সিদ্দীক, উমর ফারুক, সা'দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস, আরী উবাইদা ইবনে জাররাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুমসহ অন্যান্য নেতৃস্থানীয় সাহাবীগণ এ বাহিনীতে যোগ দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বিশাল বাহিনীর সেনাপতি হিসেবে উসামা ইবনে যায়েদকে নিয়োজিত করেন। তখনো তার বয়স ছিল বিশ বছরের চেয়েও কম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে রোম সাম্রাজ্যের 'সাজা' অঞ্চলের "আল বালকা' ও 'আদদারুম' দুর্গ পর্যন্ত অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন। সৈনাদের বিদায় মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং অসুস্থতা দিন দিন বেড়েই চলল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর স্বাস্থ্যের আশঙ্কাজনক অবস্থা অবলোকন করে এ বাহিনীর যাত্রা বিলম্বিত করা হলো। উসামা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বর্ণনা দেন

মানুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শারীরিক অবস্থা আশঙ্খাজনক পর্যায়ে পৌঁছলে আমি ও আমার সাথীরা যারা যেতে চাইলেন, তাদের নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে উপস্থিত হলাম। দেখতে পেলাম যে, তিনি শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছেন। রোগের তাড়নায় তিনি কথা পর্যন্ত বলতে পারছেন না। তিনি শুধু আকাশের দিকে তাঁর দু'হাত মুবারক উঠালেন এবং হাত দু'খানা আমার ওপর রাখলেন। আমি তাতে বুঝলাম যে, তিনি আমার জন্য দু'আ করছেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহ মুবারক থেকে তাঁর পবিত্র রূহ চিরবিদায় নিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেল। আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর হাতে খিলাফতের বাইআত সম্পন্ন হলে আৰু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু উসামা রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাহিনীকে রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু আনসারদের একটি ক্ষুদ্র অংশ এ অভিযান আরো বিলম্বিত করার পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁরা উমর ফারক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর কাছে আবেদন করেন "তিনি যেন খালীফাতুল মুসলিমীন আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাान আনহুর সাথে দেখা করে তাদের এ দাবি উপস্থাপন করেন।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.