উসামা ইবনে যায়েদ (রা) এর জীবনী শেষ পর্ব


আনসারদের সেই ক্ষুদ্র দলটি উমর ফারক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর মাধ্যমে আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর কাছে এই শর্তে দাবি জানালেন, যদি আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাদের এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেন, তাহলে আমাদের পক্ষ থেকে উসামা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর নেতৃত্বে জিহাদে অংশ নিয়ে রওয়ানা হতে কোনোই আপত্তি থাকবে না।

খালীফान মুসলিমীনের কাছে এ প্রস্তাব উত্থাপন করুন, তিনি যেন অল্প বয়সী উসামার পরিবর্তে বয়ঃপ্রাপ্ত ও অধিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন যে কোনো ব্যক্তিকে এ গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে সেনাপতি নিয়োগ করেন। উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু আনসার মুজাহিদদের ক্ষুদ্র দলটির এ প্রস্তাব নিয়ে আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর নিকট উত্থাপন করার উদ্দেশ্যে দেখা করেন। আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁর মুখে আনসারদের এই প্রস্তাব উচ্চারণ মাত্রই তিনি এক লাফে উঠে দাঁড়ান এবং সাথে সাথে উমর ফারক রাদিয়াল্লাহু তাআলা

আনহুর দাড়ি ধরে ক্রূদ্ধ স্বরে বলতে লাগলেন “হে ইবনে খাত্তাব, তোমার মা তোমার জন্য বিলাপ করুন এবং তোমাকে চিরবিদায় করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসামাকে সেনাপতি নিযুক্ত করেছেন, আর তুমি তাকে অপসারণের প্রস্তাব নিয়ে এসেছ? আল্লাহর শপথ! তা কখনো হতে পারে না এবং হবে না।' উমর ফারক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাদের নিকট ফিরে এলে তারা আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি উত্তরে বললেন : "আপনারা উসামার নেতৃত্বেই অভিযানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ুন। আপনাদের মা আপনাদের হারিয়ে ফেলুক। আপনাদের প্রস্তাব উপস্থাপন করতে গিয়ে খালীফাতুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কী যে অপমানিত হয়েছি।' যুবক সেনাপতি উসামা ইবনে যায়েন রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমার নেতৃত্বে এই বিশাল বাহিনী মদীনা থেকে রওয়ানা হলে উসামা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ঘোড়ায় চড়ে এই বাহিনীর আগে আগে চলছিলেন আর খালীফাতুর রাসুলুল্লাহ আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁর সাথে হেঁটে হেঁটে মদীনার সীমানা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলেন। উসামা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে বলেন : "হে আল্লাহর রাসূলের খলীফা, আল্লাহর শপথ! হয় আপনি ঘোড়ার পিঠে। আরোহণ করে আমাদের এগিয়ে দিন, অন্যথায় আমি নিজেই নিচে নেমে আপনার সাথে হেঁটে হেঁটে অগ্রসর হব। আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু উত্তর দিলেন "আল্লাহর শপথ! তুমি ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতে পারবে না। আল্লাহর শপথ! আমিও ঘোড়ায় উঠব না। আমি কি জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর পথে একটি ঘণ্টা নিজের পা দুটি ধূলিমলিন করব না?"। অতঃপর তিনি উসামাকে বললেন 'তোমার দীন, আমানতদারী এবং উত্তম পরিণতির জন্য আল্লাহর কাছে সোপর্দ করছি। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যতদূর পর্যন্ত অভিযান পরিচালনার জন্য তোমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, সে পর্যন্ত অভিযান চালানোর জন্য উপদেশ দিচ্ছি।' অতঃপর আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহ তাআলা আনহু উসামা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে বললেন

যদি তুমি উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে আমার সহযোগিতার জন্য মদীনাতে থাকার অনুমতি দেওয়া পছন্দ কর, তাহলে তাকে মদীনায় অবস্থানের অনুমতি দাও।' আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর এই অনুরোধের প্রেক্ষিতে উসামা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে মদীনায় অবস্থানের জন্য ফেরৎ পাঠান। অতঃপর উসামা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ মোতাবেক এই অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে 'খুমুল বালকা' ও ফিলিস্তীনের 'আদদারুম দুর্গ' এবং কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত জয় করেন। এই বিজয়ের ফলে রোম সম্রাটের মধ্যে ভয়াবহ ভীতি ও চরম আতঙ্কের সৃষ্টি হয় ও মুতার যুদ্ধে পরাজয়ের পর মুসলমানদের অন্তরে প্রতিষ্ঠিত রোমানদের প্রতি ভয়ভীতি চিরতরে দূরীভূত হয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, সমস্ত মুসলমানের জন্য সিরিয়া এলাকা, মিসর ও উত্তর আফ্রিকাসহ আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত বিজয়ের পথ সুগম হয়ে উঠে, যার মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রের পরিধির বিস্তৃতি সম্ভব হয়। এই অব্যাহত বিজয়ের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত উসামা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু সেই ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করেছিলেন, যে ঘোড়ার পিঠে তাঁর পিতা শহীদ হয়েছিলেন। তাঁর সাথে আজ বিজয়ের গৌরব ও যোদ্ধাদের বহনকৃত মালে গনীমতের অঢেল সম্পদ। যে সম্পদ সম্পর্কে বলা হয় : "উসামা ইবনে যায়েদ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর বাহিনীর মতো রক্তপাতবিহীন এবং মালে গনীমতের অঢেল সম্পদ অর্জন আর কোনো সেনাপতির সময়ে সম্ভব হয়নি। উসামা ইবনে যায়েদ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁর সমস্ত জীবন মুসলমানদের সম্মান ও শ্রদ্ধা এবং ভক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন। যেমন ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের অনুগত ও নিবেদিত তেমনই ছিলেন অত্যন্ত স্নেহধন্য ।
উমর ফারক রাদিয়াল্লাহ তাআলা আনহু তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমার চেয়ে উসামা ইবনে যায়েন রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমার জন্য অধিক সরকারি ভাতা নির্ধারণ করলে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁর পিতা উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহ, ফাআলা আনহুর কাছে আপত্তি জানিয়ে বলেন : "হে পিতা! আপনি উসামা ইবনে যায়েদের জন্য নির্ধারণ করেছেন চার হাজার দিরহাম আর আমার জন্য তিন হাজার দিরহাম। তার পিতা তো আপনার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। তেমনি সেও আমার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ নয়। উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাকে বলেন : 'তোমার এ অহমিকার জন্য তোমাকে ধিক্কার। তুমি বাস্তবতার চেয়ে অনেক দূরে অবস্থান করছ। নিঃসন্দেহে উসামার পিতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তোমার পিতার চেয়ে অধিক প্রিয় ছিলেন। তেমনি সে নিজেও তোমার চেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট অনেক বেশি প্রিয়। পিতার এ কথা শুনে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমা অত্যন্ত বিনয় ও সন্তুষ্টচিত্তে তার জন্য ধার্যকৃত ভাতায় রাজি হয়ে গেলেন। উমর ফাজক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর সাথে উসামা ইবনে যায়েদ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমার সাক্ষাৎ হলে তিনি বলতেন : "মারহাবা! খোশ আমদেদ। হে আমার আমীর।" জনৈক ব্যক্তি উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর এ উক্তিতে আশ্চর্যান্বিত হলে উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন : *রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে আমার আমীর নিযুক্ত করেছিলেন।' আল্লাহ এই বিরাট গুণাবলিসম্পন্ন মহান ব্যক্তির ওপর তাঁর করুণা ও মহব্বতের হাত সম্প্রসারণ করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের মধ্যে এমন গুরুত্বপূর্ণ, মহান ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, বহুমুখী গুণের অধিকারী প্রাণপুরুষ ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া নিঃসন্দেহে দুরূহ।

1 টি মন্তব্য:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.