সাঈদ ইবনে যায়েদ (রা) এর জীবনী পর্ব ১

 


হে আল্লাহ, তুমি যদিও আমাকে এই উত্তম দীন থেকে বঞ্চিত করেছ, কিন্তু আমার ছেলে সাঈদকে এই দীন থেকে বঞ্চিত করো না। সাঈদ (রা)-এর পিতা যায়েদের মুআ যায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফাইল জন-কোলাহল থেকে বেশ দূরে অবস্থান নিয়ে কুরাইশদের কোনো এক অনুষ্ঠানের কর্মসূচি দেখছিলেন। তিনি দেখতে পেলেন, পুরুষেরা দামি দামি রেশমি পাগড়ি মাথায় বেঁধে ইয়ামেনের তৈরি গাউন পরিধান করে অনুষ্ঠানে ঘোরাফিরা করছে। মহিলারা ও ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রং-বেরঙের জামা, কাপড়-চোপড় ও বিচিত্র অলংকারাদি পরিধান করে দলবদ্ধভাবে সমবেত হচ্ছে ও মেলার শোভা বর্ধন করছে। সম্পদশালী ও ধনী ব্যক্তিরা নানা বয়সের ও নানা ধরনের পতকে রঙিন সাজে সজ্জিত করে দেবতার সন্তুষ্টির জন্য বলি দেওয়ার উদ্দেশ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফাইল খানায়ে কা'বার দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে এসব দৃশ্য দেখছিলেন। এক পর্যায়ে কুরাইশদের সম্বোধন করে বলতে থাকলেন : 'হে কুরাইশ সম্প্রদায়। ভেড়া বকরির স্রষ্টা হলেন আল্লাহ। আকাশ থেকে তাদের জন্য আল্লাহ বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তাদের বেঁচে থাকার জন্য পানি ও ঘাস দিয়েছেন, যা খেয়ে ওরা জীবন ধারণ করে। তোমরা কেন এগুলোকে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে বলি দিচ্ছ? তোমরা বড়ই অজ্ঞ ও মূর্খ। এ কথা শোনামাত্র তাঁর চাচা, উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর পিতা খাত্তাব ভীষণ রেগে যায় এবং তাকে সজোরে চপেটাঘাত করে বলে :

“তুই নিপাত যা! এ ধরনের ধৃষ্টতাপূর্ণ কথা এর আগেও তোর মুখ থেকে বহুবার শুনেছি। প্রতিবারই আমরা ধৈর্য ধারণ করেছি। এখন আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়েছে। খাত্তাবের এ বকাবকি ও চপেটাঘাতের সুযোগে তারই স্বগোত্রীয় নির্বোধেরা নুফাইলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রহার করতে করতে তাকে মক্কা থেকে বের করে দেয়। তিনি হেরা পর্বতে আশ্রয় নেন। খাত্তাব কুরাইশ গোত্রের দুষ্ট ছেলেদের বলে দেয়, তোমরা প্রহরায় থাকবে, যাতে সে মক্কায় প্রবেশ করতে না পারে। তাই গোপনে সবার দৃষ্টি এড়ানো ছাড়া যায়েদ ইবনে আমর মক্কায় প্রবেশ করতে পারতেন না। যায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফাইল ক্ষান্ত হওয়া বা থেমে যাওয়ার মতো পুরুষ ছিলেন না। তিনি কুরাইশদের নজর এড়িয়ে ওয়ারাকা ইবনে নাওফেল, আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ, উসমান ইবনে হারেস, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফুফু উমাইয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিবের সাথে নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ করতে থাকেন ও শিরকে নিমজ্জিত কুরাইশদের ব্যাপারে সমালোচনা করতে থাকেন। যায়েদ তাদেরকে বলেন : “আল্লাহর শপথ! তোমরা এটা ভালো করেই জান যে, তোমাদের জাতি মূর্খতা ও অজ্ঞতায় নিমজ্জিত। তাদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের সাথে দীনে ইবরাহীমের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রকৃতপক্ষে তোমরা দীনে ইবরাহীমের বিপরীতে চলছ। যদি তোমরা নাজাত পেতে চাও, তাহলে তোমরা নতুন কোনো ধর্মের সন্ধান কর। কুরাইশদের এই চার গুণীজন ইহুদী ও খ্রিস্টানসহ সমসাময়িক অন্যান্য ধর্মের ধর্মীয় নেতাদের কাছে গিয়ে ধর্ম সম্পর্কে জানার আপ্রাণ চেষ্টা চালান এবং ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দীনে হানীফের সন্ধান করতে থাকেন। তাদের মধ্য থেকে ওয়ারাকা ইবনে নাওফেল খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ ও উসমান ইবনে হারেসের মন আকৃষ্ট হয়নি প্রচলিত কোনো ধর্মের প্রতি। যায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফাইল-এর নতুন ধর্ম সন্ধানের ব্যাপারে এক চমৎকার ঘটনা রয়েছে। তার নিজ বর্ণনা থেকেই সে ঘটনা অবগত হোন।

ইবনে আমর ইবনে নুফাইল বলেন : “আমি ইহুদী ও খ্রিস্টান পাদ্রিদের সান্নিধ্যে গিয়ে তাদের কাছে আমার মনের আবেগ প্রকাশ করি; কিন্তু মনকে প্রশান্তি দেওয়ার মতো কোনো আকীদা-বিশ্বাসের সন্ধান তাদের কাছে পাইনি। অতঃপর আমি সবখানে মিল্লাতে ইবরাহীমের সন্ধান করতে থাকি। এ অনুসন্ধানেরই এক পর্যায়ে আমি সিরিয়ায় পৌঁছি। সেখানে গিয়ে জানতে পারি এক পাদ্রির কাছে আসমানী কিতাবের শিক্ষা রয়েছে। ঐ পাদ্রির সান্নিধ্যে পেলাম। তাকে আমার মনের কথা খুলে বললাম। তিনি বললেন : "হে মক্কার ভাই, আমার ধারণা যে, তুমি দীনে ইবরাহীমের সন্ধান করছ। উত্তর "হ্যাঁ, সেটাই আমার জীবনের একমাত্র কাম্য।' তিনি বললেন : তুমি এমন একটি ধর্মের সন্ধান করছ, যা বর্তমানে হারিয়ে গেছে। তুমি আর ঘোরাফেরা না করে মক্কায় চলে যাও। আল্লাহ শীঘ্রই তোমাদের গোত্রে এমন এক নবী প্রেরণ করবেন, যিনি দীনে ইবরাহীমকে তোমাদের কাছে পেশ করবেন। যদি তোমার জীবদ্দশায় তাকে পেয়ে যাও নিঃসন্দেহে তার অনুসরণ করো।' একথা শুনে যায়েদ দ্রুত মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন। মক্কায় তার আগমনের পূর্বেই আল্লাহ দীনে হক ও হেদায়াতসহ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে যায়েদের সাক্ষাৎ হলো না। কারণ, বেদুইন দস্যুদের একটি দল তাকে পথে আক্রমণ করলে তিনি পথেই জীবন হারান। এভাবেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দর্শন থেকে তার চক্ষুদ্বয় বঞ্চিত থাকে। যায়েদ অন্তিম অবস্থায় আকাশের দিকে তাকিয়ে সর্বশেষ যে কথাগুলো উচ্চারণ করতে থাকেন তা হলো 'হে আল্লাহ! আমাকে যদিও এই কল্যাণ থেকে তুমি বঞ্চিত করলে, কিন্তু আমার ছেলে সাঈদকে তা থেকে বঞ্চিত করো না।'

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.