সাঈদ ইবনে যায়েদ (রা) এর জীবনী শেষ পর্ব

 


আল্লাহ যায়েদের এই দু'আ কবুল করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনগণকে ইসলামের দাওয়াত দিতে আরম্ভ করলে প্রথম সারির যেসব সাহাবী আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেন ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাতের সাক্ষ্য দান করেন, সাঈদ ছিলেন তাঁদেরই অন্যতম। সাঈদ-এর মতো ব্যক্তির সর্বাগ্রে ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে আশ্চর্যের কিছুই নেই। কারণ, সত্যিকার অর্থেই সাঈদ এমন একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যে পরিবারের প্রতিটি সদস্যই ছিল কুরাইশদের ধর্মীয় রীতি-নীতির চরম বিরোধী। তিনি এমন এক পিতার সন্তান ছিলেন, যার গোটা জীবনই শেষ হয়েছে সত্যের সন্ধানে। সাঈদ ইবনে যায়েন শুধু একাই ইসলাম গ্রহণ করেননি, বরং তাঁর সাথে তাঁর স্ত্রী উমর ইবনে খাত্তাবের বোন ফাতেমা বিনতে খাত্তাবও ইসলাম গ্রহণ করেন। এই কুরাইশ যুবক ইসলাম গ্রহণের অপরাধে তার গোত্রের যে কোনো ব্যক্তির তুলনায় বেশি নির্যাতন ভোগ করেছেন। তার ওপর অবর্ণনীয় যুলুম-অত্যাচার হওয়া সত্ত্বেও কুরাইশরা তাকে ও তার স্ত্রীকে ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি; বরং তার স্ত্রী ফাতেমা কুরাইশদের থেকে এমন এক লৌহ মানবকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন, যার গুরুত্ব ইসলামের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। অতীব গুরুত্বপূর্ণ সেই ব্যক্তি হলেন উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু। সাঈদ ইবনে যায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফাইল রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি যৌবনের সর্বশক্তি ইসলামের সম্প্রসারণে নিয়োগ করেন। তিনি একমাত্র বদর যুদ্ধ ছাড়া আর সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বদর যুদ্ধের দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বিশেষ এক গুরুত্বপূর্ণ কাজে মদীনার বাইরে প্রেরণ করলে তিনি বদর যুদ্ধে অংশ নেওয়া থেকে বঞ্চিত হন। পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের পতনের জন্য মুসলিম বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অভিযানেও তিনি শরীক ছিলেন। শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণই করেননি; বরং তিনি উভয় যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন।


ইয়ারমুকের যুদ্ধে সাঈদ ইবনে যায়েদের বীরত্ব ও সাফল্য তো রীতিমত ইতিহাস। সৃষ্টি করেছে। তাঁর নিজের থেকেই আমরা ঐ দিনের তাঁর বীরত্বের ঘটনা শুনি "ইয়ারমুক যুদ্ধে আমরা ছিলাম প্রায় (২৪,০০০) চব্বিশ হাজার যোদ্ধা। অন্যদিকে রোমানদের সৈন্যসংখ্যা ছিল ১,২০,০০০ (এক লাখ বিশ হাজার)। এই বিশাল সৈন্যবাহিনী ধীরগতিতে এমনভাবে আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, যেন অদৃশ্য শক্তিতে চালিত চলন্ত এক পাহাড়। এ বাহিনীর অগ্রভাগে ছিল ক্রুশ। এই ক্রুশ বহন করছিল বিশপ পাদ্রি ও সন্ন্যাসীরা। তারা জোরে জোরে স্লোগান দিচ্ছিল। সৈন্যরাও সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করে শ্লোগানের উত্তর দিচ্ছিল এবং তা বজ্রের ন্যায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। "রোমানদের বিরাট বাহিনীর এ দৃশ্য ও বিপুল সংখ্যাধিক্য মুসলিম বাহিনীর মনেও কিছুটা ভীতির সঞ্চার করে। এ অবস্থায় আবূ উবাইদা ইবনে আল জারবাহ দাঁড়িয়ে তাদেরকে লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। তিনি বলেন : 'হে আল্লাহর বান্দাগণ, আপনারা জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর পথে আল্লাহর জন্য লড়াই করুন। আল্লাহ আপনাদের সাহায্য করবেন এবং শত্রু বাহিনীর মোকাবেলায় আপনাদের অবস্থানকে দৃঢ়তা দান করবেন। হে আল্লাহর বান্দারা, ধৈর্য ধারণ করুন। ধৈর্যই কুফরী থেকে পরিত্রাণ, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং অপমান ও গ্লানি থেকে অব্যাহতি লাভের একমাত্র উপায়। আপনারা বর্মের সাহায্যে নিজেদের সুরক্ষিত করুন এবং বর্ণাসমূহকে তাক করে ধরুন। পূর্ণ নীরবতা পালন করুন। মনে মনে শুধু আল্লাহর স্মরণ করতে থাকুন। ইনশাআল্লাহ আমি এখনই যুদ্ধ আরম্ভ করার নির্দেশ দিচ্ছি সাঈদ ইবনে যায়েদ বর্ণনা করেন এ মুহূর্তে মুসলিম বাহিনীর এক যোদ্ধা তার ব্যূহ থেকে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে আবূ উবাইদাহ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে বলেন :

আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, এ মুহূর্তেই শাহাদাতবরণ করব। রাসুলুল্লা সারারাত আলাইহি ওয়াসারামকে কি আপনার তরফ থেকে কোনো সংবাদ দেওয়ার আছে? তাহলে তা আমার মাধ্যমে প্রেরণ করতে পারেন। আবু উবাইদা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে বললেন : “হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমার ও মুসলিম বাহিনীর পক্ষ থেকে সালাম জানাবেন এবং তাঁকে বলবেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আল্লাহ আমাদের সাথে যে ওয়াদা করেছিলেন তার সবটাই আমরা হাতে হাতে পেয়েছি । সাঈদ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন : "তার এ কথা শোনার পরক্ষণেই আমি দেখলাম, সে কোষ থেকে তরবারি উন্মুক্ত করে শত্রুবাহিনীর ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। সাথে সাথে আমিও নিচু হয়ে দু-হাঁটুতে ভর দিয়ে বর্ণা তাক করে আমার দিকে অগ্রসরমান প্রথম অশ্বারোহী শত্রুকে চ্যালেঞ্জ করেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। দেখলাম, সেই মুহূর্তে আমার মনের সব ভীতি দূর হয়ে গেছে। মুহূর্তের মধ্যে আমার বর্ণার আভাগ তার দেহ ভেদ করে পিছন দিক দিয়ে বের হয়ে গেল। সবাই এ মুহূর্তে রোমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং প্রাণপণে লড়াই করতে থাকল। পরিশেষে, আল্লাহ মুসলিম বাহিনীকে বিজয় দান করলেন। সাঈদ ইবনে যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এরপর সিরিয়ার রাজধানী দামেশক বিরায়ে অংশ নেন। দামেশকবাসী মুসলিম বাহিনীর আনুগত্য স্বীকার করলে আবু উবাইদা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁকে দামেশকের গভর্নর নিযুক্ত করেন। তিনিই দামেশকের প্রথম মুসলিম গভর্নর। বনু উমাইয়ার শাসনামলে সাঈদ ইবনে যায়েদের জীবনে এমন একটি ঘটনা ঘটে, যে বিষয়ে মদীনাবাসী দীর্ঘদিন পর্যন্ত আলোচনা করতে থাকে। ঘটনার সূত্রপাত হয় এভাবে, আরওয়া বিনতে ওয়াইস নামের এক মহিলা এ সন্দেহ করে যে, সাঈদ ইবনে যায়েদ তার জমির কিছু অংশ নিজ জমির সাথে একীভূত করে নিয়েছেন।

এ বিষয়ে সমাজের সর্বস্তরে সে তার অভিযোগ ছড়াতে থাকে। এখানেই শেষ নয়, সে মদীনার গভর্নর মারওয়ান ইবনে হাকামের কাছেও বিচার দাবি করে। মারওয়ান ইবনে হাকাম এর নিষ্পত্তির লক্ষ্যে তার কাছে কতিপয় লোক প্রেরণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই সাহাবীর বিষয়টি বড়ই পীড়াদায়ক বলে মনে হয় । সাঈদ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন : 'সে মনে করে যে, আমি তার প্রতি যুলুম করছি। কিভাবে আমার পক্ষে তা সম্ভব আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে : من ظلم شيرا من الأرض طوقت يوم القيامة من سبع أرضين . “যে ব্যক্তি অন্যের এক বিঘত ভূমিও যুলুম করে নেবে কিয়ামতের দিন তার গলায় সাত স্তবক পর্যন্ত ভূমি ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।” ইয়া আল্লাহ! যে দাবি করছে, আমি তার জমি দখল করে নিজ সীমানার অন্তর্ভুক্ত করেছি, সে যদি মিথ্যাবাদিনী হয়, তাহলে তাকে অন্ধ করে দাও এবং যে কূপ আমি দখল করেছি বলে অভিযোগ করেছে, তার মধ্যে তাকে নিক্ষেপ করো। আমার পক্ষে এমন জ্বলন্ত প্রমাণ দেখাও যাতে সবাই জানতে পারে যে, আমি তার ওপর যুলুম করিনি। কিছুদিন যেতে না যেতেই মদীনায় প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে ভীষণ বন্যা হয়, যার ফলে আকীক উপত্যকা বন্যায় ভেসে যায়। এমন বন্যা অতীতে আর কখনো দেখা যায়নি। এ বন্যায় জমির সীমানার ওপর জন্মে ওঠা মাটির স্তূপ ধুয়ে যায় এবং প্রকৃত সীমানা বের হয়ে পড়ে। ফলে মদীনাবাসী জানতে পারে যে, সাঈদ ইবনে যায়েদ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তার দাবিতে সত্য ও সঠিক। এর প্রায় এক মাসের মধ্যেই সেই মহিলা অন্ধ হয়ে যায় এবং অন্ধাবস্থায় সে তার জমিতেই চলাফেরার এক পর্যায়ে সেই কূপে নিপতিত হয়। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমা বলেন : "আমরা ছোট বেলায় লোকদের অভিশাপ দিতে শুনতাম।” তারা বলত যে ,

*আল্লাহ তোমাকে আরওয়ার মতো অন্ধ করে দিক।' এতে বিশ্বয়ের কিছু নেই। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: اتقوا دعوة المظلوم فإنه ليس بينها وبين الله حجاب . 'মযলুমের বদদু'আ থেকে সতর্ক থাকো। কেননা, মযলুমের দু'আ ও আল্লাহর মাঝে কোনোই অন্তরাল থাকে না।' এখানে মযলুম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী সাঈদ ইবনে যায়েদ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু, যিনি আশারায়ে মুবাশশারার অন্যতম ।


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.