উমাইর ইবনে সা'দ (রা) এর জীবনী পর্ব ১ম

 


(বাল্য জীবন ) উমাইর ইবনে সা'দ (রা) এক বিরল ব্যক্তিত্ব। -উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহ তাআলা আনহ পিতৃহীন শিশু উমাইর ইবনে সা'দ জন্ম থেকেই সীমাহীন অভাব-অনটন ও অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে জীবনাতিবাহিত করতে থাকেন। তাঁর পিতা তাঁকে অভিভাবক ও কপর্দকহীন রেখে ইনতিকাল করেন। তাঁর অসহায় মা আওস গোত্রের জুলাস ইবনে সুওয়াইদ নামক ধনাঢ্য জনৈক ব্যক্তির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জুলাস ইবনে সুওয়াইদ শিশু উমাইর ইবনে সা'দকেও তার মা'র সাথে নিজ পরিবারভুক্ত করে তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। জুলাস উমাইরকে এমন পিতৃস্নেহে সযত্নে লালন-পালন করতে থাকে যে, উমাইর তাঁর পিতৃবিয়োগের কথা একেবারেই ভুলে যায়। উমাইর যেমন জুলাসকে নিজ পিতার মতোই ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সম্মান করত, তেমনি জুলাসও উমাইরকে নিজ সন্তানের মতোই আদর ও স্নেহ করত। উমাইরের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার প্রতি জুলাসের স্নেহও বাড়তে থাকে। প্রতিটি কাজে, আচার-আচরণে, চলাফেরায়, শিষ্টাচারে, নীতি-নৈতিকতায়, চারিত্রিক গুণাবলিতে, সততা ও দীনদারীতে উমাইরের সমকক্ষ দ্বিতীয় আর কাউকে জুলাস দেখেনি। তাই উমাইরের প্রতি জুলাস খুবই খুশি। দশ বছর বয়স হওয়ার আগেই উমাইর ইসলাম গ্রহণ করেন। নিষ্পাপ বালক উমাইরের পবিত্র অন্তরে ইসলাম তার সৌরভ ছড়াতে থাকে। শিশুকাল থেকেই উমাইর নিয়মিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে জামাআতে নামায আদায়ে অভ্যন্ত হয়ে ওঠেন। উমাইরকে কখনো একা একা, কখনো বা স্বামীর সাথে মসজিদে নববীতে নামাযের উদ্দেশ্যে যাতায়াত করতে দেখে উমাইরের মায়ের বুক আনন্দে ভরে উঠতো। সোহাগ-যত্নে ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে আনন্দঘন পরিবেশে উমাইর খুবই শান্তির সাথে দিনাতিপাত করছিলেন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাঁর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অন্তরায় বলতে কিছু ছিল না; কিন্তু এই ঈমানদার কিশোরকে আল্লাহ এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করলেন। এত অল্প বয়সে খুব কমই কেউ এরূপ কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছে।

নবম হিজরীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোমান সম্রাটের বিরুদ্ধে তাবুক যুদ্ধের ঘোষণা দিলেন এবং এ যুদ্ধের জন্য আর্থিক সাহায্য ও মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সর্বস্তরের মুসলমানদের কাছে উদাত্ত আহবান জানালেন। যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো যুদ্ধাভিযানে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন, তখন কার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছেন বা কোন দিকে অভিযান পরিচালনা করতে যাচ্ছেন তা কখনো প্রকাশ করতেন না। বরং যেদিকে অভিযান পরিচালনা করতেন, ভাবখানা এমন দেখাতেন, যেন তার বিপরীত দিকে অভিযান পরিচালিত হবে। কিন্তু তাবুকের যুদ্ধে এর বিপরীত ঘটনা ঘটল। এবার তিনি প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে যুদ্ধ যাত্রার ঘোষণা দিলেন। এর কারণ হয়তো এই ছিল যে, যুদ্ধক্ষেত্রের দূরত্ব ও দুর্গম পথ অতিক্রম করা ও বিশাল শত্রুবাহিনীর মোকাবেলায় মুসলমানরা নিজেদের সার্বিক প্রস্তুতির পূর্ণ সুযোগ যেন গ্রহণ করতে পারে। সময়টিও ছিল এমন যে, গ্রীষ্মের দাবদাহ চলছিল, খেজুর কাটা আরম্ভ হয়েছিল। মরুভূমির প্রচণ্ড গরমে ছায়া-শীতল পরিবেশের প্রতি মানুষ যেন খুবই আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল । আরাম-আয়েশ ও অলসতা লোকালয়কে অনেকটা আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। এ পরিস্থিতি সত্ত্বেও মুসলমানগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আহবানে সাড়া দিয়ে যথাসাধ্য যুদ্ধের সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অপরদিকে মুনাফিক শ্রেণী নানাভাবে মুসলমানদের সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করে তাদেরকে নিরুৎসাহিত করতে থাকল এবং সভা ও মাহফিলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে নানারূপ কুৎসা রটনা ও অযথা ইঙ্গিত করতে থাকল। এমনকি মুনাফিকরা বিশেষ বিশেষ বৈঠকে এমন সব অকথ্য ভাষায় মন্তব্য করতে শুরু করল, যা সন্দেহাতীতভাবে কুফরীর পর্যায়ে পড়ে। যুদ্ধ প্রস্তুতির দিনগুলোর কোনো একদিন উমাইর মসজিদে নববী থেকে নামায আদাষশেষে যে অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখলেন, তা তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করল। কিভাবে মুজাহিদরা জিহাদের জন্য প্রতিযোগিতামূলক নাম লেখাচ্ছেন, জিহাদের ফান্ডে অকাতরে দানের যে প্রতিযোগিতা চলছে, তাও তিনি স্বচক্ষে দেখলেন। এসব দৃশ্য দেখে তিনি অভিভূত হলেন। তিনি আরো দেখছিলেন, মুহাজির ও আনসার রমণীরা দলে দলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে হাজির হয়ে তাদের হাতের বালা, গলার মালা ও অন্যান্য স্বর্ণালংকার খুলে পেশ করছেন। এসবের বিক্রয়লব্ধ অর্থ জিহাদে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধা ও জিহাদের বহুমুখী প্রয়োজনে ব্যয় করার জন্য তারা আবেদন জানাচ্ছেন। তিনি স্বচক্ষে এও প্রত্যক্ষ করালেন যে, উসমান ইবনে আফফান রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ১০০০ (এক হাজার) স্বর্ণমুদ্রার একটি থলে এনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসারামের খিদমতে পেশ করলেন। আবদুর রহমান ইবনে আওফ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ২০০ (দুই শত) স্বর্ণখণ্ডের একটি বস্তা কাঁধে করে এনে রাসূলুয়াহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে পেশ করলেন। এমনকি এক ব্যক্তি তার বিছানাপত্র এনে হাজির করলেন, যেন তা বিক্রি করে বিক্রয় অর্থ জিহাদের প্রয়োজনে তরবারি ক্রয়ে ব্যয় করা হয়। ত্যাগ ও কুরবানীর এসব ঘটনা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে একদিকে উমাইর যেমন উৎসাহিত ও আনন্দিত হন, অপরদিকে জুলাসের বিপুল অর্থ-সম্পদ থাকা সত্ত্বেও কেন সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আহবানে সাড়া দিচ্ছেন না, তা দেখেও অবাক হচ্ছিলেন। জুলাসের মনে যুদ্ধে অংশগ্রহণের আগ্রহ সৃষ্টি ও ঈমানী চেতনা জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে মসজিদে প্রত্যক্ষ করা ঘটনাবলি উমাইর তাকে শোনাতে মনস্থ করলেন। বিশেষ করে সমরার ও যানবাহনবিহীন লোকদের কথা, যারা ঈমানী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে নিজেদের পেশ করছিলেন এই বলে যে, তাদেরকে অস্ত্র ও যানবাহন সরবরাহ করলে তারা জিহাদে অংশগ্রহণ করতে প্রস্তুত, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ফেরৎ দিচ্ছিলেন। কারণ, তার কাছে এত गानान ছিল না। তারা জিহাদে অংশগ্রহণ করতে এবং শাহাদাতের জান্নাতী সুধা পানে ব্যর্থ হয়ে ভগ্নহৃদয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে স্ব-স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। এ সব দৃশ্যও জুলাসের কাছে উমাইর বর্ণনা করতে সিদ্ধান্ত নিলেন। অতঃপর এসব ঘটনা ও দৃশ্য উমাইর তাকে বলতে লাগলেন। আর অত্যন্ত আগ্রহভরে জুলাসও তার কথাগুলো শুনছিল। এসব শুনতে শুনতে হঠাৎ জুলাস এমন একটি মন্তব্য করে ফেলল, যা শুনে উমাইর হতভম্ব হয়ে গেলেন। কুলাসের সে কথা ছিল এই মুহাম্মদ যদি তার নবুওয়াতের দাবিতে সত্য হয়ে থাকে, তাহলে আমরা গাধার চেয়েও নিকৃষ্ট।' উমাইর তো হতভম্ব! একি জুলাসের মতো বয়ঃপ্রাপ্ত জ্ঞানী ব্যক্তির মুখ থেকে এসব বাক্য কি উচ্চারিত হতে পারে? এমন বাক্য উচ্চারণ মাত্রই ঈমান চলে যায় এবং সাথে সাথে সে কুফরীর অতল গহবরে নিমজ্জিত হয়। এই নাজুক মুহূর্তে কী করা যায়, এ নিয়ে তড়িৎ চিন্তা-ভাবনা করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, জুলাসের ব্যাপারে নীরব থাকা যায় না। তার এ কথা কাউকে না বলার অর্থই হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা। ইসলামী সংগঠন ও আন্দোলনের ক্ষতি করা এবং ইসলামবিরোধী শক্তির বিশেষ করে মুনাফিকদের সাহায্য করা। উমাইর এ কথাও চিন্তা করলেন যে, জুলাস পিতৃতুল্য এবং তার নিজের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। তার এ কথা প্রচার করা তো রীতিমতো নাফরমানী এবং তার ইহসান ও দয়ার প্রতিদানের কৃতজ্ঞ হওয়া। কারণ, তাঁর নিরাশ্রয় ও ইয়াতীম অবস্থায় জুলাস তাঁর আশ্রয়দাতা। তার যত দুঃখ-কষ্ট ও অভাব ছিল সবই তার ওসীলায় দূর হয়েছে। দুটি পরস্পরবিরোধী বিষয়ের যে কোনো একটি তাঁকে গ্রহণ করতে হবে। একটি পথই তাঁকে ধরতে হবে। তাই অতি দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি জুলাসকে বললেন : 'আল্লাহর কসম! এই ভূ-পৃষ্ঠে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর আমার নিকট আপনার চেয়ে প্রিয়জন আর কেউ নেই। আমার কাছে আপনি এমন এক অতীব প্রিয় ও সম্মানিত ব্যক্তি, যার প্রতিদান দেওয়া কোনোদিনই আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনি যা বলেছেন, তা যদি প্রকাশ করে দেই, আপনি নিঃসন্দেহে লাঞ্ছিত হবেন। আর যদি তা প্রকাশ না করি,

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.