উমাইর ইবনে সা'দ (রা) এর জীবনী পর্ব ২য়

 


তাহলে তা হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে থিয়ানত। যার অর্থ সত্য ও দীনকে ধ্বংস করে মুনাফিকদের হাতে হাত মিলানোর নামান্তর। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যে, আপনি যা বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা জানাব, আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যা করার তা করুন। এই কথা বলে উমাইর ওঠে দাঁড়ালেন এবং মসজিদে নববীর দিকে রওয়ানা হলেন। উমাইর মসজিদে নববীতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে জুলাস যে কটূক্তি করেছে তা জানালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমাইরকে তাঁর কাছে বসিয়ে রেখে এক সাহাবীকে দিয়ে জুলাস ইবনে সুওয়াইদকে ডেকে পাঠালেন। জুলাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর খিদমতে উপস্থিত হলো এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম জানিয়ে তাঁর সামনে বসে পড়ল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে উমাইরের অভিযোগের বর্ণনা দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন উমাইর যা বলেছে, তা সঠিক কি না? উত্তরে জুলাস বলল "হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ আপনার উপর শান্তি বর্ষণ করুন। সে আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছে এবং মনগড়া অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। আমি কখনো এসব বাক্য উচ্চারণ করিনি।” উপস্থিত সাহাবীগণ জুলাস ও বালক উমাইর ইবনে সা'দ-এর মুখমণ্ডলের দিকে বারবার তাকাচ্ছিলেন এবং তাদের অন্তরের গোপন অবস্থা যা তাদের চেহারায় পরিস্ফুটিত হচ্ছিল তা অবলোকনের চেষ্টা করছিলেন। তারা উভয়ের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি পেশ করতে লাগলেন। মুনাফিকদের একজন বলে উঠল "নাফরমান ছেলে। যে তার উপকার করেছে, সে তাকেই কষ্ট দিচ্ছে ও তাকেই বেইজ্জতি করছে।' সাহাবীদের একজন প্রত্যুত্তরে বললেন : “তা কী করে হয়। সে একটি খোদাভীরু ছেলে, সে ইসলামী অনুশাসনের মধ্যে বেড়ে উঠেছে। তার চেহারার অভিব্যক্তিতে সত্যবাদিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমাইরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন, তার মুখমণ্ডল অত্যধিক রক্তিম হয়ে উঠেছে এবং দু'চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে তার দু'গাল ও বুক সিক্ত করছে।

উমাইর ক্রন্দনরত স্বরে বললেন : اللهم أنزل على نبيك بيان ما تكلمت ب اللهم أنزل على نبيك بيان ما تكلمت 'হে আল্লাহ, আমি যা বলেছি, তার সমর্থনে তোমার নবীর উপর ওহী নাযিল করো। উমাইরের এই আহাজারীর প্রতিবাদে জুলাস নিজের সাফাই দিয়ে বলল : “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি আপনাকে যা বলেছি সেটাই সত্য। আপনি চাইলে আমি আপনার সামনে আল্লাহর নামে শপথ করব। আমি আল্লাহর কসম করে বলছি "উমাইর আপনাকে আমার সম্পর্কে যা বলেছে, আমি তার কিছুই বলিনি। তার এ ধরনের শপথবাক্য শ্রবণের পর উপস্থিত সবার দৃষ্টি উমাইরের প্রতি নিবন্ধ হলো। এদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর প্রশান্তভাব নেমে এল। নিখরতা আচ্ছাদিত হলো। সাহাবীগণ বুঝতে পারলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ওহী নাযিল হচ্ছে। সবাই নিজ নিজ জায়গায় নীরব ও নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহও যেন অসাড় হয়ে পড়ল। সবারই দৃষ্টি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে। না জানি কার বিপক্ষে আল্লাহর নির্দেশ অবতীর্ণ হয়। এবার জুলাস আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল। উপস্থিত সবাই বরং আনন্দ অনুভব করে উমাইরের দিকে তাকাচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর থেকে প্রশান্তভাব কেটে গেল। তিনি অবতীর্ণ ওহী তিলাওয়াত করে শোনালেন يحلفون بالله ما قالوا ولقد قالوا كلمة الكفر وكفروا بعد إسلامهم وهــوا بـمـا لم ينالوا وما تقموا إلا أن أعنهم الله

ورسوله من فضله فإن يتوبوا يك خبرا لهم وإن يتولوا بعديهم الله عذابا أليما . "তারা আল্লাহর নামে শপথ করে বলে যে, তারা কিছু বলেনি, অথচ তারা নিশ্চয়ই কুফরীর কথা বলেছে। তারা ইসলাম গ্রহণের পর কুফরী অবলম্বন করেছে। আর তারা সেসব কাজ করার ইচ্ছা করেছিল, যা তারা করতে পারেনি। তাদের এসব ক্রোধ কেবল এ কারণেই যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল স্বীয় অনুগ্রহে তাদেরকে সফল ও ধনশালী করে দিয়েছেন। এখন যদি তারা নিজেদের এ আচরণ থেকে ফিরে আসে, তবে তাদের পক্ষেই ভালো, অন্যথায় আল্লাহ তাদের অত্যন্ত পীড়াদায়ক শাস্তি দান করবেন দুনিয়ায় ও আখিরাতেও, আর পৃথিবীতে তারা নিজেদের কোনো সমর্থক ও সাহায্যকারী পাবে না।' (সূরা তাওবা: ৭৪) জুলাস তার সম্পর্কে কুরআনের অবতীর্ণ আয়াত শুনে ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে ঘরঘর করে কাঁপতে লাগল। ভয়ে তার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছিল, এমনকি মুখে একটি কথাও উচ্চারণ করতে পারছিল না। আতঙ্কিত হুলাস হাত জোড় করে কেঁদে কেঁদে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল : “আমি তাওবা করছি ইয়া রাসূলাল্লাহ্, আমি তাওবা করছি ইয়া রাসূলাল্লাহ। উমাইর সত্য বলেছে, আমিই মিথ্যাবাদী। দু'আ করুন আল্লাহ যেন আমার তাওবা কবুল করেন। আমি এ মুহূর্ত থেকে আপনার জন্য নিজেকে কুরবান করে দিলাম। আমি সত্যিকার অর্থেই আপনার খিদমতে সাচ্চা মনে নিজেকে বিলিয়ে দিলাম।' এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বালক উমাইর ইবনে সা'দ-এর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। ঈমানী জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হলো উমাইরের চেহারা, যা আনন্দাশ্রুতে সিক্ত হচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাত মোবারক স্নেহাস্পদ উমাইরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আদরভরে তাঁর কান ধরে বললেন : وقت أذنك باغلام ما سمعت وصدقك ربك .
"হে বালক! তোমার কান যা শুনেছে, যথার্থই শুনেছে এবং তোমার বব তোমার সত্যবাদিতার সাক্ষ্যদান করেছেন। এখন থেকে হুলাস সত্যিকার অর্থে ইসলামে প্রবেশ করে নিষ্ঠার সাথে ইসলামী জীবন যাপন আরম্ভ করলেন ও কায়মনে ইসলামের অনুশাসন মেনে চলতে লাগলেন। তিনি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ উমাইরের প্রতি অত্যন্ত আন্তরিকতা ও ভালোবাসার পরিচয় দিতেন বলে সাহাবীরা জানতেন। যখনই উমাইরের কথা উঠত তিনি বলতেন, আমার পক্ষ থেকে আল্লাহ তাকে উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করুক। কেননা, সে আমাকে কুফরী থেকে বাঁচিয়েছে এবং জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করেছে। যা কিছু বর্ণিত হলো তা বালক সাহাবী উমাইর ইবনে সাল-এর বিপ্লবী জীবনের শৈশবকাল মাত্র। তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে তাঁর জীবনের আর একটা বিপ্লবী দিক থেকে, যা খুবই চমৎকার ও মনোমুগ্ধকর। যা প্রিয় পাঠকদের খিদমতে তাঁর যৌবনের আর একটা চমকপ্রদ ঘটনা।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.