উমাইর ইবনে সা'দ (রা) এর জীবনী পর্ব ৩য়

 


উমাইর ইবনে সা'দ (রা) (কর্মজীবন ) "তোমাদের কাছে আশা করছি যে, তোমাদের ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতা আমার কাছে উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহ ভাষা আনহুর ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতার মতো নির্ভরযোগ্য হোক, যেন রাষ্ট্রীয় দায়িত্বভার দিয়ে আস্থা রাখতে পারি।" -উমর ইবনুল খাত (2) প্রিয় পাঠক! প্রখ্যাত সাহাবী উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর বাল্যকালের চাঞ্চল্যকর ঘটনার প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। এখন আমরা তাঁর কর্মবহুল জীবনের আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করছি। উমাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কর্মজীবনের এ ঘটনা তাঁর বাল্য-জীবনের বর্ণিত ঘটনার চেয়ে কোনো অংশে কম আকর্ষণীয় নয় । মধ্য সিরিয়ায় দামেশক ও হালাব-এর মধ্যবর্তী স্থানে 'হিম' নগরী অবস্থিত। যেখানে রয়েছে প্রখ্যাত সাহাবী খালিদ ইবনে ওয়ালীদ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর কবর। হিসবাসী সর্বদাই তাদের গভর্নরের নানাবিধ ত্রুটি-বিচ্যুতি খুঁজত এবং তিলকে তাল করে আমীরুল মুমিনীন উমর ফারক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর নিকট অভিযোগ করত। কোনো গভর্নরই তাদের তীব্র সমালোচনা থেকে মুক্ত ছিলেন না। যাকেই গভর্নর নিযুক্ত করা হতো, তারই বিভিন্ন দোষ-ত্রুটি বের করে আমীরুল মুমিনীন উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর কাছে অভিযোগ দায়ের করত এবং তদস্থলে ভালো অন্য কোনো ব্যক্তিকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগের আবেদন জানাত। এই প্রেক্ষাপটে উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহ তাআলা আনহু তাদের জন্য এমন এক ব্যক্তিকে গভর্নর নিযুক্ত করার চিন্তা করলেন, যিনি হবেন সব অভিযোগের ঊর্ধ্বে ও তাঁর চরিত্র হবে ত্রুটিমুক্ত। এ লক্ষ্যে তিনি একজন সুদক্ষ তীরন্দাযের ন্যায় তূণ থেকে একটা একটা করে তীর বের করে একটা পছন্দসই তীর বাছাই করার ন্যায় এমন এক ব্যক্তিকে খুঁজতে থাকলেন, যিনি হিস-এর গভর্নর হিসেবে উপযুক্ত হতে পারেন।

পরিশেষে তিনি উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর চেয়ে খোদাভীরু ও যোগ্য ব্যক্তি আর কাউকে পেলেন না। অথচ উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু এ সময় বিজয়ী মুজাহিদদের এক বিশাল বাহিনীর সেনানায়ক হিসেবে সিরিয়ায় যুদ্ধরত ছিলেন। তিনি সিরিয়ায় একের পর এক দুর্গ জয় করে। একদিকে ইসলামী রাষ্ট্রের পরিধি বিস্তৃত করছিলেন, অপরদিকে ঘটাচ্ছিলেন তাওহীদের ব্যাপ্তি। সে অঞ্চলের গোত্রগুলো তাঁর আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার করে ইসলামে দীক্ষা নিতে শুরু করে। বিজিত অঞ্চলের প্রতিটি জনপদে তিনি ইসলামী শিক্ষা এবং ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে মসজিদ নির্মাণ করতে থাকেন। ইসলামী জ্ঞান ও শিক্ষাবিস্তারের মাধ্যমে সকল নাগরিকের ঈমানী মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে মযবুত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত থাকার পরও আমীরুল মুমিনীন উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাকে মদীনায় ডেকে পাঠান। তিনি মদীনায় পৌঁছলে তাঁকে হিমস প্রদেশের গভর্নর হিসাবে নিযুক্ত করেন এবং সেখানে গিয়ে দায়িত্বভার বুঝে নিতে নির্দেশ দেন। একজন সৈনিক হিসেবে আল্লাহর পথে জিহাদের চেয়ে তাঁর কাছে গভর্নরের পদটি অধিক গৌরবের ছিল না। তাই তিনি তা গ্রহণ করতে অনীহা প্রকাশ করলেও পরিশেষে আমীরুল মুমিনীন উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে সে পদ গ্রহণ করতে সম্মত হলেন। উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু নবনিযুক্ত গভর্নর হিসেবে হিসে পৌঁছে জনসাধারণকে হিমুসের জামে মসজিদে সমবেত হতে আহ্বান জানালেন। নামায শেষে উপস্থিত জনসাধারণের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে সর্বাগ্রে আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দরূদ পাঠ করে বললেন :
"প্রিয় ভাইয়েরা, ইসলাম নিঃসন্দেহে একটি সুরক্ষিত দুর্গ, তেমনি এর দরজাও দুর্ভেদ্য। আর ইসলামের দুর্গ হলো ন্যায়বিচার এবং এর দরকা হলো ইনসাফ বা ন্যায়পরায়ণতা। ন্যায়বিচারে পক্ষপাতিত্ব, সত্যের পরিপন্থী কার্যকলাপ, ইসলামের দুর্গকে ভেঙে চুরমার করে দেয়, যা ইসলামকে ধ্বংস করার শামিল। ইসলাম ততক্ষণ পর্যন্ত বিজয়ী ও শক্তির উৎস হিসেবে বিদ্যমান থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত শাসক তার শাসন ক্ষমতায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। শাসকের বলিষ্ঠ ভূমিকার অর্থ ক্ষমতাবলে জনগণকে দমিয়ে রাখা বা তলোয়ারের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে নিপাত করা নয়; বরং ন্যায়বিচার ও সত্যবাদিতায় অটল থাকা। এই সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পর তিনি জনগণের সামনে তাঁর কর্মসূচি তুলে ধরলেন। উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু দীর্ঘ এক বছর অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে হিমুসের শাসনভার পরিচালনা করেন। হিমসবাসী আমীরুল মুমিনীন উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর কাছে কোনো অভিযোগ করেননি। আর না এ সময়ে উমাইর রাদিয়াল্লাহ আনহু উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর কাছে কোনো পত্র দেন কিংবা কেন্দ্রীয় বায়তুল মালে মিরাজের এক কপর্দক প্রেরণ করেন। এ দীর্ঘ নীরবতা উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর মনে সন্দেহের উদ্রেক করে। কেননা, তিনি তাঁর গভর্নরদের প্রতি সর্বদাই সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন, যেন। ক্ষমতা তাদের কোনো রকম অন্যায় কাজে জড়িত না করে ফেলে। কারণ, উমর ফারক রাদিয়াল্লাহ তাআলা আনহুর দৃষ্টিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত কোনো ব্যক্তিই মাসুম বা নিষ্পাপ হিসেবে গণ্য ছিলেন না। অতঃপর তিনি তাঁর সেক্রেটারিকে নির্দেশ দিলেন যে, উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে এই বলে নির্দেশ প্রেরণ করুন যে, এ পত্র পাওয়ামাত্র হিন্‌স ছেড়ে আমীরুল মুমিনীন-এর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে মদীনায় চলে আসুন এবং আসার প্রাক্কালে মুসলমানদের দ্বিরাজের যে অর্থ সংগ্রহ করেছেন তাও সঙ্গে নিয়ে আসু উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু আমীরুল মুমিনীন উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর পক্ষ থেকে পত্র পাওয়ামাত্রই হিসবাসীর কাছ থেকে বিদায় নিলেন।
অতঃপর তাঁর খাদ্যদ্রব্য বহনের একমাত্র থলেটিতে ওযু করার বদনাটি ঢোকালেন, যুদ্ধাস্ত্র ও বর্মটি হাতে নিলেন এবং হিমস নগর-এর গভর্নরের পদটি পেছনে রেখে পদব্রজে মরুপথে মদীনার দিকে রওনা হলেন। মদীনায় পৌঁছতে উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর চেহারা কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করল। পানাহারের অভাবে স্বাস্থ্য দুর্বল হয়ে পড়ল, দাড়ি, গোঁফ ও মাথার চুল লম্বা হয়ে গেল এবং সফরের ক্লান্তি তাঁকে ভীষণভাবে দুর্বল করে ফেলল। ভগ্ন স্বাস্থ্য, ক্লান্ত দেহে উমাইর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর দরবারে হাজির হলেন। তাঁর অবস্থা দেখে উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হতভম্ব হয়ে গেলেন এবং বলে উঠলেন উমাইর! তোমার এ কী অবস্থা হয়েছে?" উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু খালীফাতুল মুসলিমীনকে উত্তর দিলেন : 'কিছু হয়নি আমীরুল মুমিনীন। আল্লাহর রহমতে আমার স্বাস্থ্য ভালো। কুরবানীর পশুকে যেভাবে তার দুটি শিং ধরে করায়ত্ত করা হয়, সেভাবেই দুনিয়াকে সম্পূর্ণ বহন করে এনেছি।' উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাকে জিজ্ঞাসা করলেন : ঠিক তুমি সাথে করে কী পরিমাণ দুনিয়া বহন করে এনেছ?' উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ভাবছিলেন যে, বায়তুলমালের জন্য পর্যাপ্ত ঘিরাজের অর্থ বহন করে এনেছেন। উমাইর ইবনে সা'দ উত্তরে বললেন "আমার বহন করে আনা সম্পদের মধ্যে আমার থলিটিতে আমার জিনিসপত্র স্তরে এনেছি। যার একটি হলো প্লেট, যাতে খাবার খাই, কখনো বা তাতে কাপড়-চোপড় ধুই, কখনো বা তাতে পানি নিয়ে গোসল করি এবং একটি বদনা যা ওযু ও পানি পানের জন্য ব্যবহার করে থাকি। এই আমার পুরো দুনিয়া। হে আমীরুল মুমিনীন! এরচেয়ে অধিক আর কিছুই আমার প্রয়োজন নেই। এমনকি আমার পরে আমার পক্ষের নিকটতমদের জন্যও নয়। উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু জিজ্ঞাসা করলেন : “তুমি কি হিন্‌স থেকে হেঁটে এসেছ?” উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু উত্তর দিলেন : "জী হ্যাঁ, আমীরুল মুমিনীন।
উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু জিজ্ঞাসা করলেন : রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আরোহণের জন্য একটি ঘোড়াও দেওয়া হয়নি? উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু উত্তর দিলেন : "হিস-এর বর্তমান দায়িত্বশীলগণ আমার জন্য এ ব্যবস্থা করেননি এবং আমিও তাদের কাছে তা চাইনি। উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন বাইতুল মালের জন্য যা কিছু এনেছ তা কোথায়? উমাইর ইবনে সা'দ জানালেন "খালি হাতেই এসেছি। উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহ তাআলা আনহু প্রশ্ন করলেন "কেন?" তিনি উত্তর দিলেন : “হিন্‌স পৌঁছে সেখানকার খোদাভীরু, নেক ও সৎ লোকদের একত্র করি এবং তাদেরকে জনগণ হতে বিরাজ সংগ্রহ করার দায়িত্ব নেই। যখনই তারা মিরাজের অর্থ সংগ্রহ করে আনত, তা কিভাবে খরচ করা যায়, সে ব্যাপারে তাদের সাথে পরামর্শ করে প্রকৃত অভাবী লোকদের মধ্যে তা বিতরণ ও যথাযথ খাতে ব্যয় করা হতো। আমীরুল মুমিনীন উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু উমাইর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে হিমসের গভর্নর হিসেবে বহাল রাখার লিখিত ফরমান দেওয়ার জন্য সেক্রেটারিকে নির্দেশ দিলেন। উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু সে পদে পুনরায় যোগদানে অপারগতা প্রকাশ করে বললেন : 'আমি এই দায়িত্ব গ্রহণে অপারগতা জানাচ্ছি। আমীরুল মুমিনীন! আমি কোনোক্রমেই আপনার অর্পিত এই দায়িত্বভার নিতে আগ্রহী নই। শুধু আপনারই নয়, আপনার পরেও যদি কেউ এ দায়িত্ব আমাকে অর্পণ করেন, তাঁর দেওয়া এ দায়িত্বও গ্রহণ করব না।' অতঃপর উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর কাছে মদীনার পার্শ্ববর্তী স্থানে নিজ গ্রামে যেখানে তাঁর পরিবার-পরিজন অবস্থান করছেন তাদের সঙ্গেই বসবাস

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.