উমাইর ইবনে সা'দ (রা) এর জীবনী শেষ পর্ব

 


করার অনুমতি চাইলে উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁকে সেখানে বসবাসের অনুমতি প্রদান করেন। উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কিছুদিন যেতে না যেতেই উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁর সাবেক গভর্নরকে পরীক্ষা করতে মনস্থ করলেন। উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু হিম্‌স থেকে ফিরে এসে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার উদ্যোগ নিলেন। আমীরুল মুমিনীন উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁর একান্ত আস্থাভাজন হারেস নামক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে ডেকে বললেন : "হারেস। উমাইরের বাড়িতে অতিথি হিসেবে যাও এবং তার সাথে সাক্ষাৎ কর। যদি তার মধ্যে বিন্দুমাত্র ভোগ-বিলাসিতা বা স্বাচ্ছন্দ্যের লক্ষণ দেখ, তবে কিছু না বলে মেহমান হিসেবেই চলে এস। আর যদি দেখ যে, দারিদ্র্যক্লিষ্ট অবস্থায় অভাব-অনটনে দিনাতিপাত করছে, তাহলে স্বর্ণমুদ্রার এই থলিটি তাকে অর্পণ কর।' এই বলে উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ১০০ স্বর্ণমুদ্রার থলিটি হারেসের হাতে দিলেন। উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর নির্দেশে হারিস উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হলেন ও জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তার বাড়ি খুঁজে বের করলেন। উমাইর-এর সাথে দেখা হওয়া মাত্র বললেন : আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। জওয়াবান্তে। উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু আগন্তুককে জিজ্ঞাসা করলেন “আপনি কোথা থেকে আগমন করেছেন?" হারেস উত্তর দিলেন : মদীনা মুনাওয়ারা থেকে উমাইর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন : “সেখানকার মুসলমানদের অবস্থা কেমন দেখে এসেছেন?”

হারেস উত্তর দিলেন : 'ভালো

উমাইর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু প্রশ্ন করলেন *আমীরুল মুমিনীন উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু কেমন আছেন? হারেস উত্তর দিলেন: *ভালো ও নেক শাসক হিসেবে দায়িত্বে রত আছে। উমাইর আবার প্রশ্ন করলেন: 'তিনি কি হদ' জারি করেন?" হারেস উত্তর দিলেন : 'অবশ্যই। তাঁর ছেলেকেও ব্যভিচারের অপরাধে অপরাধী হওয়ার কারণে বেত্রাঘাত করেছেন, এমনকি বেত্রাঘাতের কারণে সে মৃত্যুবরণ করেছে। উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু একথা শুনে বললেন : "হে আল্লাহ! তুমি উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে সাহায্য কর আমি তাঁর মতো আর কাউকে তোমাকে এত গভীরভাবে ভালোবাসতে দেখিনি। অতঃপর উমাইর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর দাওয়াতে হারিস তাঁর বাড়িতে। তিন রাত কাটালেন। প্রতিটি রাতে মেহমানকে একটি মাত্র যবের পাতলা শুকনো রুটি খেতে দিতেন। তৃতীয় রাতে তাঁর গোত্রের এক ব্যক্তি তাঁর মেহমান হারেসকে উদ্দেশ্য করে বললেন : "হে মেহমান! আপনি উমাইরের মেহমান হয়ে তাঁকে এবং তার স্ত্রীকে মহা বিপদে ফেলেছেন। তাদের ঘরে যবের এই পাতলা শুকনো রুটি ছাড়া অন্য কোনো খাবার নেই। তাও গত তিনদিন যাবৎ আপনাকে খেতে দিয়ে তারা উভয়েই ক্ষুধার্ত ও কষ্টের মধ্যে নিপতিত হয়েছেন। যদি মনে কিছু না করেন, তবে তাঁর পরিবর্তে আমার বাড়িতে মেহমান হতে পারেন। তখন হারেস তার নিকট উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর দেওয়া স্বর্ণমুদ্রা বের করে উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে প্রদান করলেন। উমাইর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বললেন : 'এটা কী?' ১. শরীআতের দৃষ্টিতে সরকারীভাবে ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীকে প্রকারভেদে বেত্রাঘাত বা পাথর মেরে হত্যা করাকে "হদ্দ" বলে।

হারেস উত্তর দিলেন “আমীরুল মুমিনীন উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু এগুলো আপনাকে পৌঁছানোর জন্য আমাকে প্রেরণ করেছেন। উমাইর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তা গ্রহণ না করে হারেসকে বললেন : "উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে এসব ফেরৎ দিয়ে তাঁকে আমার সালাম জানাবেন আর বলবেন যে, উমাইরের এই স্বর্ণমুদ্রার কোনো প্রয়োজন নেই।' উমাইর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর স্ত্রী পর্দার আড়াল থেকে মেহমান ও উমাইর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর মধ্যকার কথোপকথন শুনছিলেন। তিনি স্বামীকে বললেন : গ্রহণ করুন, গ্রহণ করুন। যদি প্রয়োজন বোধ করেন নিজের জন্য চ করুন, নতুবা প্রকৃত হকদারদের মধ্যে বিতরণ করুন। এখানে তো অগণিত অভাবী লোকজন রয়েছে। হারেস তাঁর স্ত্রীর প্রস্তাব শুনে স্বর্ণমুদ্রাগুলো উমাইর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর সামনে রেখে দ্রুত উঠে পড়লেন। উমাইর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু স্বর্ণমুদ্রাগুলো ছোট ছোট থলেতে ভরে গরীব-মিসকীন, বিধবা ও অসহায় বিশেষ করে শহীদ পরিবারের অসহায় সদস্যদের মাঝে রাতেই বিতরণ করেন। হারেস মদীনায় ফিরে এলে উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী দেখে এলে হারেস? হারেস উত্তর দিলেন : 'চরম সংকটাপন্ন অবস্থা।' উমর ফারক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাকে প্রশ্ন করলেন : স্বর্ণমুদ্রাগুলো কি তাকে দিয়েছো?" হারেস উত্তর দিলেন : “হ্যাঁ, হে আমীরুল মুমিনীন!" উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু করলেন "সে তা কী করেছে?" হারেস বললেন : "জানি না, তবে মনে হচ্ছে, সে তার জন্য স্বর্ণমুদ্রা কেন, একটি রৌপ্য মুদ্রার সমপরিমাণও রাখবে না । হারেসের এ বক্তব্য শোনে উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে পত্র প্রেরণ

করলেন। তাতে লিখলেন : আমার এই পত্র পাওয়ার সাথে সাথে এমনকি পত্রখানা হাত থেকে রাখার পূর্বেই আমার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হও।" আমীরুল মুমিনীনের নির্দেশ মোতাবেক উমাইর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু মদীনার পথে রওয়ানা হলেন। উমর ফারক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর দরবারে প্রবেশ করামাত্র খালীফাতুল মুসলিমীন তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। সম্মানের সাথে নিজের পাশে বসতে দিলেন এবং কুশল বিনিময়ের এক পর্যায়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন: "স্বর্ণমুদ্রাগুলো কী করেছ? উমাইর উত্তর দিলেন : "যখন স্বর্ণমুদ্রাগুলো আমার জন্য পাঠিয়েছেন, তখন সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে উমর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বললেন : কী লাভ?' “আমি আশা করছি, তুমি সেসব স্বর্ণমুদ্রা দ্বারা কী করলে আমাকে একটু জানাবে। উমাইর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বললেন : "আমার নিজের জন্য সংরক্ষণ করেছি। যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোনো কাজে আসবে না, সেদিন তা আমার উপকারে আসবে ভেবে। তার এ উত্তর শুনে উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর দু'চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তিনি বলে উঠলেন : “উমাইর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, তুমি নিশ্চয়ই সেসব লোকের অন্তর্ভুক্ত, যারা নিজের প্রয়োজনের উপর প্রাধান্য দেয়, যদিও তারা ভীষণ অভাবী ।" অতঃপর উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু উমাইর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে এক ওয়াসাক-৬০ সা' যা বহনে একটি উটের প্রয়োজন হয়- পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য ও এক জোড়া কাপড় প্রদানের নির্দেশ দিলেন।

মাইর রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বললেন আমীরুল মুমিনীন! আমাদের খাদ্যের প্রয়োজন নেই। আমি আসার সময় পরিবারের জন্য দু' সা' পরিমাণ যব রেখে এসেছি। আশা করছি, এ দু' সা' যব শেষ হতে না হতেই আল্লাহ আমাদের জন্য আরো রিযিকের ব্যবস্থা করবেন। আর কাপড় জোড়া নিচ্ছি এ জন্য যে, আমার স্ত্রীর কাপড় এমনভাবে ছিঁড়ে গেছে যে, সে প্রায় বিবস্ত্র হয়ে পড়েছে। উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর সাথে এ সাক্ষাতের পর কিছুদিন যেতে না যেতেই উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে আল্লাহ এ দুনিয়া থেকে পরপারে আহবান জানালেন। তাঁর দীর্ঘদিনের আশা যে, পরকালে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাতে মিলিত হবেন। দুনিয়ার এ মায়াবী বেড়াজাল থেকে মুক্ত পবিত্র আত্মার অধিকারী এ সাধক সাহাবী উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু রহমত ও মাগফিরাতের দৃঢ় প্রত্যাশী ছিলেন। তাই তিনি দুনিয়ার সর্বপ্রকার বিষয় ও দায়দায়িত্ব হতে মুক্ত হয়ে পরকালের পথে নির্ঝঞ্চাটভাবে রওনা হতে সক্ষম হন। যাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে তাঁর সাথে ছিল তাঁর ইবাদত-বন্দেগী, তাকওয়া-পরহেযগারী, হেদায়াত, দৃঢ় ঈমান ও নেক আমল এবং নূরের দীর্ঘ মশাল। তাঁর ওফাতের সংবাদ শোনামাত্র উমর ফারক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর চেহারা মলিন হয়ে যায় এবং বেদনায় মন ভেঙে পড়ে। তিনি বলেন : “আমি কতই না আশা করছিলাম যে, উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর মতো লোক পাব, যাদেরকে মুসলমানদের খিদমতের জন্য রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়োগ করতে পারব।' আল্লাহ্ উমাইর ইবনে সা'দ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর ওপর সন্তুষ্ট হোন এবং তাঁকেও সন্তুষ্ট করুন। নিঃসন্দেহে কর্মবীরদের মধ্যে তিনি এক ব্যতিক্রমধর্মী, অনুকরণযোগ্য মহানবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক মহান ব্যক্তিত্ব।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.