সহীহ মুসলিম

 



পরিচ্ছেদঃ ১. ঈমান, ইসলাম ও ইহসান প্রসঙ্গ, তাকদীরে বিশ্বাসের আবশ্যিকতা, যে ব্যাক্তি তাকদীর অবিশ্বাস করে তাঁর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ অপরিহার্য হওয়ার দলীল ও তাঁর সম্পর্কে কঠোর ভাষা ব্যবহার। আবুল হুসায়ন মুসলিম ইবনুল হজ্জাজ আল-কুশায়রী (রহঃ) বলেন, আল্লাহ্‌ তা'আলার সাহায্যে শুরু করছি এবং প্রার্থনা করছি যেন তিনিই আমার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। বস্তুত মহান আল্লাহ্‌র সাহায্য ছাড়া আমরা কোন কিছুই করতে সমর্থ নই।

হাদিস নং ১ম পরিচ্ছেদ এর ( ১ থেকে ৬ )

১। আবূ খায়সামা যুহায়র ইবনু হারব (রহঃ) ইয়াহইয়া ইবনু ইয়া’মার (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি (ইয়াহইয়া ইবনু ইয়া’মার) বলেন, সর্বপ্রথম তাকদীর’ সম্পর্কে বসরা শহরে মাবাদ আল জুহানী কথা তোলেন। আমি (ইয়াহইয়া ইবনু ইয়া’মার) এবং হুমায়দ ইবনু আব্দুর রহমান আল হিমায়রী হাজ্জ (হজ্জ) অথবা উমরা আদায়ের জন্য মক্কা মু’আযযামায় আসলাম। আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলাম যে, যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর কোন সাহাবীর সাক্ষাৎ পাই তাহলে তাঁর কাছে এসব লোক তাকদীর সম্পর্কে যা বলে বেড়াচ্ছে, সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করতাম।

সৌভাগ্যক্রমে মসজিদে নববীতে আমরা আবদুল্লাহ ইবনু উমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ)-এর দেখা পাই। আমরা তাঁর কাছে গিয়ে একজন তাঁর ডানপাশে এবং আর একজন বামপাশে বসলাম। আমার মনে হলো, আমার সাথী চান যে, আমিই কথা বলি। আমি আরয করলাম, হে আবূ আবদুর রহমান! আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ)-এর কুনিয়াত ছিল আবূ আবদুর রহমান। আমার দেশে এমন কতিপয় লোকের আবির্ভাব হয়েছে যারা কুরআন পাঠ করে এবং ইল্‌মে দ্বীন সম্পর্কে গবেষণা করে। তিনি তাদের অবস্হা সম্পর্কে আরো কিছু উল্লেখ করেন এবং বলেন যে, তারা মনে করে তাকদীর- বলতে কিছু নেই। সবকিছু তাৎক্ষনিকভাবে ঘটে। আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) বললেন, তাদের সাথে তোমাদের দেখা হলে বলে দিও যে, তাদের সাথে আমার কোন সস্পর্ক নেই এবং আমার সঙ্গে তাদেরও কোন সম্পর্ক নেই। আল্লাহর কসম! যদি এদের কেউ উহুদ পাহাড় পরিমাণ সোনার মালিক হয় এবং তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে, তাকদীরের প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত আল্লাহ তা কবুল করবেন না।

তারপর তিনি বললেন, আমাকে আমার পিতা উমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ) হাদীস শুনিয়েছেন যে, একদা আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর খিদমতে ছিলাম। এমন সময় একজন লোক আমাদের কাছে এসে হাযির হলেন। তাঁর পরিধানের কাপড় ছিল সা’দা ধবধবে, মাথার কেশ ছিল কাল কুচকুচে। তাঁর মধ্যে সফরের কোন চিহ্ন ছিল না। আমরা কেউ তাঁকে চিনি না। তিনি নিজের দুই হাঁটু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর দুই হাঁটুর সাথে লাগিয়ে বসে পড়লেন আর তার দুই হাত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর দুই উরুর উপর রাখলেন।

তারপর তিনি বললেন, হে মুহাম্মদ! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে অবহিত করুন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ইসলাম হল, তুমি এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল, সালাত (নামায/নামাজ) কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, রামাযানের রোযা পালন করবে এবং বায়তুল্লাহ পৌছার সামর্থ্য থাকলে হাজ্জ (হজ্জ) পালন করবে। আগন্তুক বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। তার কথা শুনে আমরা বিষ্মিত হলাম যে, তিনই প্রশ্ন করেছেন আর তিনই-তা সত্যায়িত করছেন।

আগন্তুক বললেন, আমাকে ঈমান সম্পর্কে অবহিত করুন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ঈমান হল আল্লাহর প্রতি, তার ফেরেশতাদের প্রতি, তার কিতাবসমূহের প্রতি, তার রাসুলগণের প্রতি এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান আনবে, আর তাকদিরের ভালমন্দের প্রতি ঈমান রাখবে। আগন্তুক বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন।

তারপর বললেন, আমাকে ইহসান সম্পর্কে অবহিত করুন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ইহসান হলো, এমনভাবে ইবাদত-বন্দেগী করবে যেন তুমি আল্লাহকে দেখছ, যদি তুমি তাকে নাও দেখ, তাহলে ভাববে তিনি তোমাকে দেখছেন।

আগন্তুক বললেন, আমাকে কিয়ামত সম্পর্কে অবহিত করুন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এ বিষয়ে প্রশ্নকারীর চাইতে যাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে তিনি অধিক অবহিত নন। আগন্তুক বললেন, আমাকে এর আলামত সম্পর্কে অবহিত করুন। রাসুল বললেনঃ তা হলো এই যে, দাসী তার প্রভুর জননী হবে; আর নগ্নপদ, বিবস্ত্রদেহ দরিদ্র মেষপালকদের বিরাট বিরাট অট্টালিকার প্রতিযোগিতায় গর্বিত দেখতে পাবে।

উমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ) বললেন যে, পরে আগন্তুক প্রস্হান করলেন। আমি বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। তারপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, হে উমর! তুমি জানো, এই প্রশ্নকারী কে? আমি আরয করলাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই সম্যক জ্ঞাত আছেন। রাসুল বললেনঃ তিনি জিবরীল। তোমাদের তিনি দ্বীন শিক্ষা দিতে এসেছিলেন।

২। মুহাম্মাদ ইবনু উবায়দ আল গুবারী (রহঃ) ... ইয়াহইয়া ইবনু ইয়া’মার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মা’বাদ (আল জুহানী) তাকদির- সম্পর্কে তার মত ব্যক্ত করলে আমরা তা অস্বীকার করি। তিনি (ইয়াহইয়া ইবনু ইয়া’মার) বলেন, আমি ও হুমায়দ ইবনু আবদুর রহমান আল হিময়ারী হাজ্জ (হজ্জ) পালন করতে গিয়েছিলাম। এরপর কাহমাস-এর হাদীসের অনুরূপ মর্ম ও সনদের সাথে হাদীসটি বর্ণিত আছে। তবে এই বর্ণনায় কিছু বেশকম রয়েছে।

৩। মুহাম্মাদ ইবনু হাতিম (রহঃ) … ইয়াহইয়া ইবনু ইয়া’মার ও হুমায়দ ইবনু আবদুর রহমান আল হিময়ারী (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন। তাঁরা বলেন, আমরা উভয়ে আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করি এবং তাকদির- সম্পর্কে যা বলা হয়, তা নিয়ে আলোচনা করি। তারা উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত উক্ত হাদীসটি কিছু বেশ কমসহ বর্ণনা করেন।

৪। হাজ্জাজ ইবনু শা’ইর (রহঃ) .... ইয়াহইয়া ইয়া’মার (রহঃ) ইবনু উমর (রাঃ) সূত্রে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসটির উপরোক্ত হাদীসের অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

৫। আবূ বকর ইবনু আবূ শায়বা (রহঃ) ও যুহায়র ইবনু হারব (রহঃ) ... আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকসমক্ষে ছিলেন, এমতাবস্হায় তাঁর কাছে একজন লোক হাযির হলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! ঈমান কী? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ঈমান হল, আল্লাহ, তার ফেরেশতা, তাঁর কিতাবসমুহ, তাঁর সঙ্গে মুলাকাত, তাঁর প্রেরিত রাসুলদের প্রতি ঈমান আনা এবং শেষ উত্থানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।

তারপর আগন্তুক প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! ইসলাম কী? রাসুল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ ইসলাম হল, আল্লাহর ইবাদত করা, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক না করা, ফরয সালাত (নামায/নামাজ) কায়েম করা, নির্ধারিত যাকাত আদায় করা এবং রামাযানের রোযা পালন করা।

আগন্তুক আবার প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! ইহসান কী? রাসুল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ ইহসান হল, তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত- বন্দেগী করবে যেন তাঁকে দেখছ; যদি তুমি তাকে নাও দেখ, তাহলে ভাববে যে, তিনি তোমাকে দেখছেন।

আগন্তুক প্রশ্ন করলেন, কিয়ামত কখন হবে? রাসুল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ এ বিষয়ে প্রশ্নকারীর চাইতে যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে, তিনি অধিক অবহিত নন। তবে হ্যাঁ কিয়ামতের কিছু আলামত বর্ণনা করছি, দাসী তার প্রভূকে জন্ম দেবে। এটি কিয়ামতের আলামতের একটি। বিবস্ত্রদেহ, নগ্নপদ লোক হবে জনগণের নেতা; এটা কিয়ামতের আলামতের একটি। আর রাখালদের বিরাট বিরাট অট্টালিকার প্রতিযোগিতায় গর্বিত দেখতে পাবে, এটিও কিয়ামতের একটি আলামত।

পাঁচটি বিষয়ে আল্লাহ ব্যতীত কেউ কিছু জানেনা। এ বলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (এ আয়াতটি) তিলাওয়াত করেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ, তাঁরই কাছে রয়েছে কিয়ামতের জ্ঞান। তিনি নাযিল করেন বৃষ্টি এবং তিনি জানেন, যা রয়েছে মাতৃগর্ভে। আর কেউ জাননা কি কামাই করবে সে আগামীকাল এবং জাননা কেউ কোন মাটিতে সে মারা যারে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব জানেন, সব খবর রাখেন। (সূরা লূকমানঃ ৩৪)

রাবী বলেন, তারপর লোকটি চলে গেল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ লোকটিকে আমার কাছে ফিরিয়ে আন। তাঁরা তাকে আনার জন্য গেলেন। কিন্তু কাউকে পেলেন না। তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ইনি জিবরীল (আলাইহিস সালাম) লোকদের দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার জন্য এসেছিলেন।

৬। মুহাম্মদ ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু নুমায়র (রহঃ) ... আবূ হায়্যান আত তায়মী (রহঃ) থেকে উক্ত সনদে অনুরুপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। তবে তাঁর বর্ণনায় إِذَا وَلَدَتِ الأَمَةُ رَبَّهَا এর স্থলে إِذَا وَلَدَتِ الأَمَةُ بَعْلَهَا অর্থাৎ দাসী তার স্বামীকে জন্ম দেবে, কথাটির উল্লেখ রয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.