মুরগীর গামবোরো রোগের লক্ষণ কারন ও প্রতিকার

 

 মুরগীর গামবোরো রোগ ঃ

ভাইরাস জনিত রোগ গামবোরো। বাংলাদেশের খামারিদের বড় এক সমস্যা হলো মুরগির রোগ। মুরগির গামবোরো হওয়ার সময় ২ মাস বয়স হলে কিংবা কাছাকাছি সময়ে। মুরগির গামবোরো রোগের চিকিৎসা না জানলে এতে খামার উজাড় হয়ে যায়।

সর্বপ্রথম আমেরিকার সাসেক্স এর গামবোরো নামক স্থানে ১৯৬২ সালে এটি প্রথম শনাক্ত হয়। গামবোরো হলে এটি মুরগির লসিকা গ্রন্থি ‘বারসাকে‘ আক্রান্ত করে বলে একে ‘ইনফেকসাস বারসাল ডিজিজ‘ও বলা হয়।এ রোগে মুরগির রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আক্রান্ত হয় তাই গামবেরো রোগকে আভাইন এইডস বলে আখ্যায়িত করা হয়। এ রোগে মৃত্যুর হার ২০- ৯০%।

রোগের বিস্তার ঃ

গামবোরো রোগ সাধারণত ৩-৬ সপ্তাহের মুরগির বাচ্চায় তীব্র আকারে দেখা দেয়। তবে ০-৩ সপ্তাহের বাচ্চায় এ রোগ হতে পারে। মুরগি ছাড়া হাঁস, টার্কি এবং গিনি ফাউলে এ রোগ হয়।

আক্রান্ত বাচ্চা মুরগির পায়খানার মাধ্যমে এই ভাইরাস পরিবেশে আসে, পরে দূষিত খাদ্য, পানি এবং লিটারের (মুরগির  বিছানা) মাধ্যমে এ ভাইরাস এক মুরগি থেকে অন্য মুরগিতে ছড়ায়। বিভিন্ন ধরনের জীবাণুনাশক এবং পরিবেশের বিরুদ্ধে এই ভাইরাস প্রতিরোধ গড়ে  তুলতে পারে এবং আক্রান্ত মুরগির ঘরে এই ভাইরাস ৪মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।

তাই কোন ফ্লক একবার আক্রান্ত হলে পরবর্তী ফ্লক আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। বাচ্চার দেহে এ রোগের মা থেকে প্রাপ্ত এন্টিবডির মাত্রা না জেনে টিকা দিলে এ রোগ হতে পারে।   বিভিন্ন ধরনের ধকল এ রোগ হওয়ার জন্য সহায়ক ভূমিকা হিসেবে পালন করে। ক্রটিযুক্ত টিকার মাধ্যমে এ রোগ ছড়াতে পারে।

গামবোরো রোগের লক্ষনসমূহ

বাহ্যিক লক্ষনসমূহঃ

বাহ্যিক লক্ষণ দেখে এ রোগ নির্ণয় করা কষ্টকর। অন্যান্য মুরগির রোগের মতো এ রোগ লক্ষণ প্রকাশ করে থাকে।

সাধারণত নিম্নলিখিত লক্ষণ দেখা যায়–

হঠাৎ করে শুরু হয় এবং মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। সাধারণত আক্রান্ত হওয়ার প্রথম ২দিন মৃত্যুর হার বেশি থাকে এবং শেষের ২-৩ দিনের মধ্যে মৃত্যুর হার দ্রুত কমে যায়।
মুরগির পালক উসকো-খুসকো থাকে।
পাতলা পায়খানা করে, পায়খানায় চুনের পরিমাণ বেশি থাকে এবং পানিশূন্যতায় ভোগে।
অনেক মুরগি নড়া-চড়া করতে অনীহা দেখায় এবং একজায়গায় বসে থাকে।
শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং কাঁপতে থাকে।
মুরগিরমধ্যে ঝিমানো ভাব দেখা যায়।
খাদ্য ও পানি গ্রহণ করার ক্ষমতা কমে যায় যার ফলে ওজন হ্রাস পায়।
অনেক মুরগির পা ল্যাংড়া হয়ে যায়।

আভ্যন্তরীন লক্ষনসমূহঃ

পা ও রানের মাংসের ওপর ছোপ ছোপ রক্তের ছিটা দেখা যায়।
মুরগির বারসা ফুলে যায় এবং বার্সা কাটলে ভিতরে রক্তের ছিটা দেখা যায়।
কলিজা বেশ বড় ও ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
কিডনি বড় হয়ে যায়।
গামবোরো রোগের ভাইরাস এর প্রথম টার্গেট হলো বার্সা ফেব্রিসিয়াস নামক রোগপ্রতিরোধ অংগ। ভাইরাস আক্রান্তের ১-৩ দিনের মধ্যে বাসা ফেব্রিসিয়াস ফুলে যাবে এবং জিলাটিন জাতীয় পানি পাওয়া যাবে।
আক্রান্ত মুরগির বয়স ৩-৮ দিন হলে বার্সা ফেব্রিসিয়াস ছোট হয়ে যাবে।
আক্রান্ত মুরগির বয়স ৮-১৩ দিন হলে বার্সা ফেব্রিসিয়াস এর লুমেন এ কেজিয়াস কোর পাওয়া যায়।
মুরগীর দুই পায়ের রানের মাংসে ফোটা ফোটা রক্ত বিন্দু পাওয়া যাবে।
মিরগির কিডনী অনেক ফুলে যায় এবং কিডনি তে ইউরেট জমা থাকতে দেখা যায়।
মুরগীর বুকের মাংসে ফোটা ফোটা রক্ত বিন্দু বা হিমোরেজ দেখতে পাওয়া যাবে।

মুরগির গামবোরো রোগের চিকিৎসা ঃ

গামবোরো হলে মুরগির ডিহাইড্রেশন হয়। ফলে মুরগির প্রচুর ইলেক্ট্রোলাইট ঘাটতি পড়ে। এজন্য স্যালাইন পানি বা অনেকে গুড়ের পানি সরবরাহের কথা বলে থাকেন। দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য এন্টিবায়োটিক (অক্সিটেট্রা সাইক্লিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন) দেয়া যেতে পারে। তার সঙ্গে ভিটামিনস (ভিটামিন-সি), ইলেকট্রোলাইট দিলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।

প্রতিরোধ টিকা কর্মসূচি ঃ

গামবোরো রোগ প্রতিরোধের জন্য  টিকা ব্যবহার করতে হবে। যে কোন বাচ্চার টিকা দেয়ার আগে মা থেকে প্রাপ্ত এন্টিবডির মাত্রা জেনে নিতে হবে। সুস্থ বাচ্চাকে টিকা দিতে হবে এবং অসুস্থ বাচ্চাকে টিকা দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। টিকা দেয়ার সময় বাচ্চার ওপর যেন কোনো ধকল না পরে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ব্রয়লার বাচ্চার ক্ষেত্রে সাধারণত ১৪ দিন বয়সে জীবন্ত টিকা দেয়া হয়। টিকা ড্রপারের মাধ্যমে বা খাওয়ার পানির মাধ্যমে দেয়া যেতে পারে। ব্রয়লারের বুস্টার ডোজ ২১-২৮ দিনের মধ্যে দেয়া যেতে পারে। লেয়ারের  ক্ষেত্রে  সাধারণত  ১ দিন বয়সে  মৃত টিকা দেয়া হয় ।তারপর  ১৪ দিন ও ২১–২৮ (বুস্টার  ডোজ) দিনের  মধ্যে জীবন্ত টিকা দেয়া হয়। ব্রয়লারের ক্ষেত্রে মৃত  টিকা দেয়ার  প্রয়োজন হয় না কারণ তার জন্য দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধ করার দরকার হয় না এর আগে এর বাজারজাত করা হয়।

জৈব নিরাপত্তা:

জৈব নিরাপত্তা মেনে চললে অনেক রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। নিম্নলিখিত বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে–

খামার সবসময় পরিষ্কার-পরিছন্নরাখতে হবে। আয়োডিন যৌগ গামবোরো জীবাণুর বিরুদ্ধে জীবাণুনাশক হিসেবে ভালো কার্যকর। ০.২-০.৫% সোডিয়াম হাইপক্লোরাইট দ্রবণ ব্যবহার করা যেতে পারে।
খামারে বাহিরের লোকজন যেন প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।
খামারে পোষা পাখি, মুরগি ও গৃহপালিত প্রাণী প্রবেশ করতে দেয়া যাবেনা।
খামারে ব্যবহারের জন্য আলাদা  জুতা  ও পোশাকের ব্যবস্থা  রাখা  দরকার।
মৃতমুরগির সৎকার সঠিকভাবে করতে হবে।
মুরগির খাবার পাত্র ও পানির পাত্র, ট্যাংকি নিয়মিতডিটারজেন্ট দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করতে হবে।
স্বাস্থ্যকর খাবার দিতে হবে। খাবারে ছত্রাক বা অন্য সমস্যা থাকলে তা খাওয়ানো যাবে না।
মুরগির এক খামার থেকে অন্য খামারের দুরুত্ব কমপক্ষে ৩০০ ফুট হতে হবে।
খামারকে ইঁদুর ও মশামাছির উৎপাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
খামারে যানবাহন ঢুকানোর আগে ভালোভাবে জীবাণুনাশক দ্বারা ধুয়ে নিতে হবে।
খামারের প্রধান ফটক ও শেডের সামনে ফুট-বাথ স্থাপন করতে হবে।
মুরগির পরিচর্যার জন্য প্রত্যেক শেডের জন্য আলাদা কর্মী সম্ভব হলে নিয়োগ দিতে হবে। আর সম্ভব না হলে প্রথমে কর্মী সুস্থ মুরগির পরিচর্যা তারপর অসুস্থ মুরগির পরিচর্যা করবে।
খামারে একই বয়সের মুরগি পালন করতে হবে। অল ইন অল আউট পদ্ধতি মেনে চলতে হবে।

ব্রুডিং ব্যবস্থাপনা ঃ

ভালো হ্যাচারী থেকে সুস্থ-সবল বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে। ব্রুডিংয়ের  সময় কোন ধরনের ধকল যেন না পরে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাচ্চা ব্রুডিংয়ের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে-

ফার্মে আনার ২৪ ঘন্টা আগে ব্রুডার জ্বালাতে হবে।
ধকল যতদূরসম্ভব এড়িয়ে মুরগির ছানা বাক্স থেকে নামাতে হবে।
নামানোর পর পানি দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে বাচ্চাগুলোকে ব্রুডারে ছাড়তে হবে এবং আগে থেকে খাবার পাত্র ও পানির পাত্র ব্রুডারে প্রস্তুত রাখতে হবে।
দুর্বল ও নাভি কাঁচাযুক্ত বাচ্চাগুলোকে বাদ দিতে হবে।
পুরুষ ও মহিলা বাচ্চা আলাদাভাবে ব্রুডিং করলে ভালো হয়।
প্রতি ৪০-৫০ টি বাচ্চার জন্য ১ টি খাবার পত্র (লাইন ফিডার) ও ১ টি পানির পাত্র দরকার।
ব্রুডার লিটার থেকে ৬০ ইঞ্চি উপরে রাখতে হয়। মুরগির বাচ্চার তাপের প্রয়োজন অনুযায়ী এর তারতম্য হতে পারে।
প্রতি ৩০০-৫০০ বাচ্চার জন্য ১ টি ব্রুডার স্থাপন করতে হবে।
বৈদ্যুতিক ব্রুডারে প্রতি বাচ্চার জন্য ১.৫-২ ওয়াট বাল্বের আলোদরকার।
গ্যাস ব্রুডার ক্ষেত্রেব্রুডার এর পাইপলাইন ও গ্যাসের পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
বিদ্যুৎও গ্যাসের ব্যবস্থা না থাকলে হারিকেন দিয়ে ব্রুডিং করা যায়।
মুরগির মল-মূত্র থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরি হয় এবং তা যেন মুরগির ঘরে জমতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৩-৪ ইঞ্চি মেঝেতে (উচ্চতা) পরিমাণ লিটার (মুরগির বিছানা  যেমন ধানের কুঁড়া, কাঠের গুঁড়া) বিছাতে হবে। বিছানোর পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ১০ গ্রাম তুঁতে (কপার সালফেট) দিয়ে স্প্রে করে লিটার শুকিয়ে নিতে হবে।
সমতল সিটদিয়ে ব্রুডারের চারিদিকে বেড়া দিতে হবে। বেড়ার প্রস্থ সাধারণত ১ ফুট হয়।
ব্রুডারের লিটারের উপরপেপার বিছিয়ে দিতে হবে এবং পেপার ২ দিনের বেশি ব্যবহার করা উচিত নয়। নিয়মিত পেপার বদলাতে হবে। ভেজা লিটার থাকলে সেগুলো সরিয়ে শুকনো লিটার দিতে হবে।
প্রত্যেকখাবার পাত্রে  ক্রাম্বল/ম্যাশ/সাগুদানা জাতীয় খাবার রাখা যেতে পারে এবং পেপারের উপর খাবার দানা ছিটানো যায়।
প্রতি লিটারপানির সঙ্গে  ৪০ গ্রাম গ্লুকোজ/গুঁড়/চিনি/লেবুর রস/ভিটামিন-সি (১ গ্রাম/২ লিটার) মেশানো যায়। মিশ্রিত পানি প্রথম দিন দিতে হয়।
খাবার পাত্র ও পানির পাত্রএমন উচ্চতায় (সাধারণত মুরগির পিঠ সমান) রাখতে হবে যেন মুরগির বিষ্ঠা ও লিটার  দ্বারা খাবার ও পানি দূষিত না হয় ।
সাধারণত প্রথমদিকেপ্রতি বাচ্চার জন্য ০.৫ বর্গফুট মেঝেতে জায়গা দরকার ।
প্রতিদিন ছানার প্রয়োজন অনুযায়ী জায়গা বাড়িয়ে ৭ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ ঘরে বাচ্চা ছেড়েদিতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.